Home » বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য কি কি?
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য কি কি?

by TRI

Table of Contents

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের যে ব্যবসায়-বাণিজ্য সংঘটিত হয় তাকে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বলে। বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর বিধায় রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। সে হিসেবে এ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নিচে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য সমূহ উল্লেখ করা হলো :

১। আমদানি নির্ভরতা

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য আমদানিনির্ভর। কারণ এখানে চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ পণ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় না। তাই পণ্য রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণই বেশি। বাংলাদেশে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যসামগ্রীর গড় অনুপাত ৩ : ১। অর্থাৎ আমদানি নির্ভরতা বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

২। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এ দেশ থেকে কৃষিপণ্য বা কাঁচামাল অধিক পরিমাণে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ বলে রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য এ দেশে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। কিন্তু সে তুলনায় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নি। তাই এ ধরনের কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

৩। শিল্পজাত পণ্যের আমদানি

বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে শিল্পজাত পণ্যই বেশি আমদানি করে থাকে। কারণ এ দেশে চাহিদার তুলনায় খুব অল্প পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু শিল্পপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে । উদাহরণস্বরূপ, কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, কৃষি সরঞ্জাম, কীটনাশক ঔষধ, বৈদেশিক যন্ত্রপাতি, কয়লা, জ্বালানি তেল প্রভৃতি ।

৪। অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি

ইদানীং সরকার অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। কারণ পূর্বে এর বাজার ছিল না বললেই চলে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ধরনের পণ্য ক্রয় করে থাকে। অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে- নিউজপ্রিন্ট কাগজ, শাক-সব্জি, পান-সুপারি, ব্যাঙের পা, মাছ, দিয়াশলাই, শুটকি, চিংড়ি মাছ, ফলমূল ও ফলমূলের বীজ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:   বৈদেশিক বাণিজ্য কি? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব

৫। জনশক্তি ও তৈরি পোশাক রপ্তানি

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে জনশক্তি একটি অন্যতম রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জনশক্তির স্থান সর্বোচ্চ। জনশক্তি রপ্তানি শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই অর্জন করে না, তা মূলধন গঠনেও সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমেও এ দেশ প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

৬। আমদানি নীতি

প্রতি দু’বছর অন্তর অন্তর দেশে আমদানি-রপ্তানি নীতি ঘোষণা করা হয়ে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্যই এ নীতি প্রণয়ন করা হয়। তবে প্রয়োজনবোধে এ নীতি পরিবর্তন করা যায়। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে পণ্য আমদানির জন্য সরকার বিশেষ অনুমোদন দিয়ে থাকে।

৭। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি আয়ের ক্রমাবনতি

এক সময় পার্ট ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান সামগ্রী । তাই পাটকে ‘সোনালি আঁশ’ বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে পাটের বিকল্প আবিষ্কৃত হওয়ায় পাটের চাহিদা কমে গেছে। তবে পাট হতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, বিশেষ করে কুটির শিল্পজাত পণ্যের কিছুটা রপ্তানি বেড়েছে। আশা করা যায় এটি ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে।

৮। শিল্পপণ্যের চেয়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেশি

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পপণ্যের চেয়ে ভোগ্যপণ্য বেশি আমদানি করা হয়। এ দেশে শিল্পের ব্যাপক প্রসার না ঘটাই এর মূল কারণ। তবে বর্তমানে এ চিত্র ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন হচ্ছে। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।

৯। বেসরকারি খাতে আমদানি

সরকারি খাতের পাশাপাশি বর্তমানে বেসরকারি খাতেও পণ্য আমদানি করার সুযোগ রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বেসরকারি খাতে আমদানি ও রপ্তানির সকল সুযোগ দেয়া হয়েছে। বলা যায়, বেসরকারি খাতেই অধিকাংশ পণ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে।

১০। ওয়েজ আর্নার ক্রীম

বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করা হয়। তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এ দেশে বিনিয়োগের জন্য একটি স্কীম চালু করা হয়েছে। এ স্কীমের আওতায় বিদেশে অবস্থানরত যে কোনো বাংলাদেশী তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পণ্য আমদানি করতে পারে।

১১। প্রতিকূল ব্যবসায় উদ্বৃত্ত

বাংলাদেশের বৈদেশিক ব্যবসায়ের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ব্যবসায়িক ঘাটতি। অর্থাৎ এখানে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হয়, ফলে সব সময় প্রতিকূল ব্যবসায় ঘাটতি দেখা দেয়। এ ছাড়াও পণ্য পরিবহন বাবদ বহু অর্থ বিদেশী জাহাজ কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং এ ব্যবসায় ঘাটতি থেকেই যায়।

১২। সমুদ্র পথে অধিকাংশ ব্যবসায়

বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৯৭% ও রপ্তানির প্রায় ৯৯% সমুদ্র পথে সংঘটিত হয়। স্থলপথ ও বিমান পরিবহনের গুরুত্ব এক্ষেত্রে খুবই কম। কেবল প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে স্থল পথে সামান্য ব্যবসায় সংঘটিত হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিমান পথেও পণ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে।

১৩। বাণিজ্য মেলার আয়োজন ও অংশগ্রহণ

বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর রপ্তানি মেলার আয়োজন করা হয় এবং বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক মেলায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে থাকে। এর ফলে বিদেশে বাংলাদেশের পণ্যের পরিচিতি বাড়ছে। তাছাড়া সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ রপ্তানিকারকদেরকে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানসূচক পদক বিতরণ করা হয়।

১৪। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল

বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যবসায়কে ত্বরান্বিতকরণের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়ে থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা জেলায় এ ধরনের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (EPZ) গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও খুলনার মংলায় আরেকটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপনের কাজ চলছে। এখানে পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করার জন্য সরকার কর্তৃক ১০০% আমদানি শুল্ক মওকুফ ঘোষণা করা হয়েছে।

১৫। রপ্তানিকারক দেশ

বাংলাদেশ মূলত মুসলিম দেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি করে থাকে। তবে সার্কভুক্ত দেশ, দক্ষিণ এশীয় সংস্থা, আসিয়ান দেশসমূহ ও আমেরিকা, জাপানসহ ইউরোপের সকল দেশের সাথেই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক রয়েছে।

১৬। আমদানি দ্রব্যের বৈচিত্র্য

বাংলাদেশের বৈদেশিক ব্যবসায়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমদানিকৃত দ্রব্যের বৈচিত্র্য। ক্ষুদ্র আলপিন থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ পর্যন্ত প্রায় সব কিছুই এদেশে আমদানি করা হয়ে থাকে। রপ্তানিকৃত দ্রব্য অপেক্ষাকৃত খুবই কম।

১৭। টাকাকে তৎক্ষণাৎ রূপান্তরের ব্যবস্থা

আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াকে সহজ ও গতিশীল করার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে টাকাকে অতি সহজেই যে কোনো সময় বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করা যায়। এর ফলে আমদানিকারীগণ যে কোনো সময় পণ্য আমদানি করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে পারে।

১৮। অদৃশ্য আয়-ব্যয়

বাংলাদেশের বৈদেশিক ব্যবসায় এবং ব্যাংকিং, বিমা, পরিবহন, পর্যটন, শিক্ষা ইত্যাদি অদৃশ্য খাতে আমদানি বায় রপ্তানি আয় অপেক্ষা অধিক। তাই এরূপ অদৃশ্য খাতে বাণিজ্য ঘাটতি সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতির জন্য অনেকাংশে দায়ী।

বাংলাদেশে উল্লিখিত বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য সমূহ পরিলক্ষিত হয়। সরকার দেশের বৈদেশিক ব্যবসায়কে গতিশীল ও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

Related Posts