বৈদেশিক বাণিজ্য কি?
বৈদেশিক বাণিজ্য বলতে পরস্পর দুই বা ততোধিক দেশের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত সব ধরনের লেনদেনের সমষ্টিকে বুঝানো হয়। পৃথিবীর কোন দেশই তার নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কারণ প্রকৃতি সকল সম্পদ সমভাবে বণ্টন করে নি। তাছাড়া মানুষের চাহিদা অফুরন্ত ও সীমাহীন। এ সীমাহীন চাহিদা পরিপূরণের জন্য যে সকল পণ্যদ্রব্য বা উপকরণ প্রয়োজন তার সবগুলো কোন একটি নির্দিষ্ট দেশে উৎপন্ন হয় না। ফলে দু’টি দেশের মধ্যে চাহিদামাফিক পণ্য ক্রয়-বিক্রয় আবশ্যক হয়ে পড়ে। কাজেই দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবা কর্মাদির বিনিময় বা আদান-প্রদানকেই বৈদেশিক বাণিজ্য বলে অভিহিত করা যায়। যেমন : বাংলাদেশ যদি ভারতে কয়লা রপ্তানি করে এবং বিনিময়ে ভারত থেকে চাল আমদানি করে তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংঘটিত বাণিজ্যকে বৈদেশিক বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলা হবে।
আরও পড়ুন: বিশেষায়িত ব্যাংক কি? বিশেষায়িত ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য
বৈদেশিক বাণিজ্যের সংজ্ঞা
নিচে বৈদেশিক বাণিজ্যের কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
- J. L. Hanson এর মতে, “বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত পণ্যসামগ্রী ও সেবাদি বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিনিময় করাকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বা বৈদেশিক বাণিজ্য বলে।”
- Prof. C. P. Kindle Berzer-এর মতে, “দুই বা ততোধিক সার্বভৌম দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবার লেনদেনকে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে।”
- Prof. O. M. Amos-এর মতে, “বৈদেশিক বাণিজ্য হলো কোন দেশের জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে পণ্যসামগ্রী বিনিময় করা।”
- Prof. M. C. Vaish বলেন, “স্বাধীন বা সার্বভৌম রাষ্ট্র বা দেশসমূহের জনসাধারণের মধ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবার বিনিময়কে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে।”
অতএব, বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াকে অথবা দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে পণ্যসামগ্রী সেবাকর্মাদি ক্রয়-বিক্রয় বা আদান-প্রদান কার্যকে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
বৈদেশিক বাণিজ্য একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষ সাধন ভূমিকা রাখতে পারে। নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো : করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো-
১। উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি
কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কতকগুলো কৃষিপণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করে। এসব কৃষিপণ্যের মধ্যে পাট, চা, তামাক, আখ উল্লেখযোগ্য। এসব কৃষিজাত পণ্য দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব যা দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করা যায়।
২। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য আমদানি
বাংলাদেশে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যেমন : ভোগ্যপণ্য, ঔষধপত্র, যন্ত্রপাতি। এসব পণ্যসামগ্রী বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করে থাকে যা দেশের জনগণের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের অভাব মোচন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩। যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি
বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কলকব্জা ও কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। এতে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উদ্বৃত্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হয়। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য হয় ।
৪। জনশক্তি রপ্তানি
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোক কর্মক্ষম বেকার। দেশের এরূপ বেকার জনগোষ্ঠী বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে একদিকে বেকার সমস্যা লাঘব হয় এবং অন্যদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সঞ্চারিত হয়।
৫। খাদ্য ঘাটতি পূরণ
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশের উৎপাদিত কৃষি পণ্য দেশের জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই প্রতি বছর দেখা দেয় প্রচুর খাদ্য ঘাটতি। এরূপ খাদ্য ঘাটতি পূরণের একমাত্র বিকল্প হিসেবে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
৬। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস
বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের উপর অনেকটা নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে পারলে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। এতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্বনির্ভরতা অর্জনের গৌরব অর্জন করতে পারে।
৭। পণ্যসামগ্রীর বাজার সম্প্রসারণ
বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তাই এ দেশের পণ্যসামগ্রীর বাজার সম্প্রসারণ করতে পারলে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। অতএব, বাজার সম্প্রসারণের দিক হতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
৮। একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিরোধ
বৈদেশিক বাণিজ্য একচেটিয়া ব্যবসায় রোধে সাহায্য করে। বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ফলে বিদেশের উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী দেশের অভ্যন্তরের বাজারে আগমন করে তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে। ফলে দেশীয় পণ্যের মান উন্নত হয় এবং একচেটিয়া ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: মুদ্রা বাজার ও মূলধন বাজারের পার্থক্য কি কি?
৯। রপ্তানি বৃদ্ধি
বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। এতে দেশীয় উৎপাদকরা অধিক পরিমাণে পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে এবং দেশে ব্যাপক উৎপাদনের ধারা অব্যাহত থাকছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।
১০। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি
বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায়-বাণিজ্য গঠন ও পরিচালনার চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে দেশে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হয় যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ বহু শিল্প পার্ক স্থাপন করা হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, একটি দেশের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এতে পণ্যের আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে- যা বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে এবং একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিরোধ করে।।