বক্সারের যুদ্ধ
১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম, বাংলার নবাব মীর কাশিম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লার যৌথ বাহিনীর সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ইংরেজদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় ইতিহাসে তা বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় এ যুদ্ধের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সমগ্র ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ভরশীল ছিল এ যুদ্ধের ফলাফলের উপর। যুদ্ধে যৌথবাহিনী ইংরেজ সেনাপতি মেজর মনরোর নিকট সম্পূর্ণ পরাজিত হয়। মীর কাশিম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান এবং পলাতক অবস্থায় ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।
বক্সারের যুদ্ধের কারণ
সিংহাসনে আরাহণ করেই দেশপ্রেমিক মীর কাশিম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ভবিষ্যতে ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ সুনিশ্চিত। শ্বশুড় মীরজাফরের মতো ক্রীড়ানক হয়ে থাকার মতো মনোবৃত্তি তার ছিল না। তিনি প্রকৃত নবাব হিসেবে দেশ শাসন করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্য ইংরেজদের কবল থেকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থ উদ্ধারে কতগুলো দৃঢ় ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেন, যা বক্সারের যুদ্ধ সংঘটনে ভূমিকা রাখে। নিম্নে বক্সারের যুদ্ধের কারণ গুলো তুলে ধরা হলো-
প্রথমত, নবাব হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মীর কাশিম আর্থিক সচ্ছলতা আনার পদক্ষেপ নেন। কেননা তার শ্বশুড়ের পতনের অন্যতম কারণ ছিল আর্থিক সংকট। এজন্য তিনি চুক্তি মোতাবেক ইংরেজদের সব পাওনা পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হন। এরপর নিজের অবস্থান সুসংহত করে শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য তিনি, বাংলা, বিহারের উদ্ধত জমিদার ও বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করে আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন।
আরও পড়ুন: পলাশীর যুদ্ধ কী? পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
দ্বিতীয়ত, মীর কাশিম সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করেন যে, শাসনব্যবস্থায় ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে তারাই হবে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা। তাই প্রশাসনকে ইংরেজ প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। নতুন রাজধানীর চতুর্দিকে পরিখা ও দুর্গ নির্মাণ করে রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এবং নিজ বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সাথে মুঙ্গেরে কামান, বন্দুক ও গোলাবারুদ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন; যাতে অস্ত্রের জন্য কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়।
তৃতীয়ত, দিল্লির সম্রাটের ফরমানবলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিল। কিন্তু বাংলার নবাব কর্তৃক কোম্পানিকে দস্তক প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানির ব্যবসায়িক সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানির অসাধু কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহার করে বিনা শুল্কে দেশের অভ্যন্তর থেকে মালামাল আনা-নেওয়া শুরু করলে দেশীয় বণিকরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নবাব নিজেও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। এজন্য নবাব বাণিজ্য শুল্ক উঠিয়ে দেন। এতে দেশীয় বণিকরা লাভবান হয় যা ইংরেজদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে।
চতুর্থত, মীর কাশিম বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণের ইংরেজপ্রীতি ও দুর্নীতি লক্ষ করে তাকে পদচ্যুত এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। নবাবের উপরিউক্ত পদক্ষেপ ইংরেজদের মনে সন্দেহ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়, যা বক্সারের যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল
বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মীর কাশিমের স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বিনা বাধায় তারা এদেশে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে। এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যান। দিল্লির সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেন। মীর কাশিম পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন এবং ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।ইংরেজরা অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে কারা ও এলাহাবাদ নিজেদের অধিকারে নেয়।
বক্সারের যুদ্ধ জয়ের ফলে রবার্ট ক্লাইভ দিল্লি সম্রাটের কাছ থেকে বাৎসরিক ২৬ লাখ টাকার বিনিময়ে আনুষ্ঠানিকবাবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন। বাংলায় ইংরেজ কর্তৃত্ব আইনি স্বীকৃতি লাভ করে। এ যুদ্ধে মীর কাশিমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নবাবি আমলের সমাপ্তি ঘটে। মুঘল সম্রাটের দুর্বলতা ইংরেজদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপমহাদেশে ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ মসৃণ হয়।