পলাশীর যুদ্ধ
ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজদের সাথে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পলাশীর প্রান্তরে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, এ যুদ্ধ সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা।
নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর সাথে সাথেই সিরাজউদ্দৌল্লা তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে বাংলার নবাব পদে উপবিষ্ট হন। আলীবর্দী খান সিরাজকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে গেছেন তাঁর জীবদ্দশাতেই। কিন্তু শওকত জঙ্গ, ঘসেটি বেগম ও অন্যরা ইংরেজদের সাথে মিলে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। যে কারণে ইংরেজদের সাথে সিরাজউদ্দৌল্লার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ
একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যে কোনো দেশের মানুষের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে তার প্রমাণ মেলে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে। যেসব কারণে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা নিচে উপস্থাপন করা হলো-
১। নবাবের প্রতি ইংরেজদের অবজ্ঞা
নবাব হিসেবে অভিষেকের পর প্রচলিত রীতি অনুসারে সব বিদেশি বণিক তাকে উপহার পাঠিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করত। কিন্তু সিরাজউদ্দৌল্লা নবাব হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর ইংরেজদের কাছ থেকে সৌজন্যমূলক ও আনুগত্যের নিদর্শনসূচক কোনো উপঢৌকন লাভ করেননি; যা ইংরেজদের প্রতি সিরাজের বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
২। দুর্গের সংস্কার
দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বদ্বিতার সূত্রে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। এ কারণে ইংরেজরা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম এবং ফরাসিরা চন্দননগরে তাদের নিজ নিজ দুর্গের সংস্কার কাজ শুরু করে। সিরাজ তা বন্ধ কারা নির্দেশ দিলে ফরাসিরা মানলেও ইংরেজরা দুর্গ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যায়। ফলে সিরাজউদ্দৌল্লা তাদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হন।
৩। দস্তকের অপব্যবহার
দস্তক বা পারমিটের অপব্যবহার করে ইংরেজ কোম্পানি দেশীয় বণিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে বেশি লাভ করছিল। তাই নবাব ইংরেজদের দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করে বাণিজ্যিক শর্ত মেনে চলার আদেশ দেন। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের আদেশ অমান্য করে। এতে নবাব ইংরেজদের উপর চরম বিরক্ত হন।
আরও পড়ুন:
দ্বৈত শাসন কি? দ্বৈত শাসনের ফলাফল, গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর
৪। কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান
সিরাজের খালা ঘসেটি বেগম ও তার সহযোগি রাজবল্লভ প্রতারণার মাধ্যমে অনেক অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। নবাব তাদের একপ্রকার নজরবন্দি করেন এবং অর্থের হিসাব দাবি করেন। নবাবের তদন্তের বিষয় বুঝতে পেরে ঘসেটি বেগম ও রাজবল্লভ ৫৫ লাখ টাকা কলকাতায় পাচার করেন। রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস সেই অর্থ নিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন।
৫। নবাবের দূতকে অপমান
ইংরেজদের নিকট কৃষ্ণদাসকে ফেরত চেয়ে নবাব নারায়ণ সিংহকে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। ইংরেজরা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। তাই তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে নবাব কলকাতা দখল করেন। নবাবের আক্রমণে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে পালিয়ে যায়। হলওয়েলসহ কিছুসংখ্যক ইংরেজ আত্মসমর্পণ করে।
৬। হলওয়েলের উদ্ভাবিত অন্ধকূপ হত্যা
বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে হলওয়েল এক মিথ্যা কাহিনী প্রচার করেন, যা ইতিহাসে ‘অন্ধকূপ হত্যা’ (Blak Hole Tragedy) নামে পরিচিত। হলওয়েলের প্রচারণা অনুসারে, নবাব খুব ছোট ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখেন। ফলে প্রচন্ড গরমে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। এ খবর মাদ্রাজ পর্যন্ত পৌঁছালে উত্তেজিত ওয়াটসন ও ক্লাইভ কলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হন। তারা নবাবের সেনাপতি মানিক চাঁদকে পরাজিত করে কলকাতা দখল করেন। এবং নবাব একরকম বাধ্য হয়ে অপমানজনক সন্ধি করেন যা ইতিহাসে আলীনগরে সন্ধি নামে পরিচিত।
৭। সিরাউদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
আলীনগরের সন্ধিতে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ইংরেজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়। তারা ফরাসিদের চন্দননগর কুঠি আক্রমণ করে দখল করে নেয়। নবাব ফরাসিদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে ইংরেজদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করেন। এতে ক্লাইভ ক্ষুদ্ধ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এতে যুক্ত হন ব্যবসায়ী ধনকুবের জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উর্মিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, সেনাপতি মীরজাফর প্রমুখ।
৮। ক্লাইভের সাথে মীরজাফরের গোপন সন্ধি
নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ক্লাইভের সাথে মীরজাফর এক গোপন সন্ধি করেন। মীরজাফর ক্ষমতার মসনদে বসলে ইংরেজদের বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা এবং বিপুল অর্থ দিতে অঙ্গীকার করেন। এছাড়া নকল এক চুক্তিতে উর্মিচাঁদকে ২০ লক্ষ টাকার লোভ দেখিয়ে দলে টানেন যা আসল চুক্তিতে ছিল না। মূলত মীরজাফরের সাথে গোপন চুক্তিই ছিল পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম কারণ।
উপরোক্ত কারণগুলোর কারণে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে ভারতের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ৫০ হাজার সৈন্যর বিপরীতে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ইংরেজরা জয় পায়।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল
পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজদের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ও মৃত্যুতে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের পথ প্রশস্ত হয়। যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজরা জয়লাভ করে মীরজাফরকে বাংলার নবাবের আসনে বসালেও তিনি ছিলেন নামমাত্র নবাব। প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে।
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ফরাসিরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে ইংরেজরা ছিল ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর কৃপা ও অনুগ্রহপ্রার্থী। যুদ্ধে জয়ের ফলে ভারতীয়রা ইংরেজদের কাছে কৃপা ও অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে পড়ে।
মোটকথা, পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের স্বার্থে এদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে। এতে বাংলার সাথে সমগ্র ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব ভূলুণ্ঠিত হয়।