শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার
সুদক্ষ, বিচক্ষণ ও রণকুশলী শাসক শেরশাহের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যে রাজস্ব সংস্কার অন্যতম। তিনি স্বীয় প্রতিভার বলে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে ক্ষীণ সময়ের জন্য হলেও মুঘল সিংহাসনে বসেন। মাত্র পাঁচ বছরের রাজত্বকালে শাসনব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে তিনি সুষ্ঠু ও উন্নত শাসনব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হন।
নিম্নে শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার বর্ণনা করা হলো-
ভূমি জরিপ
রাজস্ব সংস্কার পদক্ষেপ হিসেবে শেরশাহ রাজ্যের সকল ভূমি জরিপ করেন। তিনি ভূমি জরিপ করে স্থানীয় রাজকর্মচারীদের খাজনা আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ প্রসঙ্গে ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “যে মুসলিম শাসক সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন তিনি হলেন শেরশাহ।”
আরও পড়ুন
ইবনে বতুতা কে ছিলেন? তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
শের শাহ কে ছিলেন? তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান কী?
খাজনা নির্ধারণ
ভূমি জরিপের মাধ্যমে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বিবেচনা করে তিনি জমিতে তিন ভাগে ভাগ করেন। যথা- ক) উৎকৃষ্ট, খ) মধ্যম ও গ) নিকৃষ্ট। ভূমির ধরন অনুসারে ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ হিসেবে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। উৎপাদিত ফসলের উপর খাজনা নির্ধারতি হওয়ায় কৃষককুল অত্যাচারিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনিই প্রথম জমির খাজনা নগদ অর্থে কিংবা উৎপন্ন শস্যের মাধ্যমে প্রদানের সুযোগ দেন।
খাজনার পরিমাণ
শেরশাহ জমির খাজনার পরিমাণ নির্ধারণের এক অভিনব পদ্ধতি চালু করেন। তার রাজস্ব ব্যবস্থায় জমির খাজনা নির্ধারণের হার ছিল এরূপ-
ক) এক বিঘা উৎকৃষ্টমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ১৮ মণ।
খ) এক বিঘা মধ্যমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ১২ মণ।
গ) এক বিঘা নিকৃষ্টমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ৮ মণ ৫ সের।
রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার সংস্কার
শেরশাহ রাজস্ব আদায়ের জন্য মুকাদ্দাম, চৌধুরী, পাটোয়ারি নামক কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। প্রজারা ইচ্ছা করলে সরাসরি রাজকোষে রাজস্ব জমা দিতে পারত। রাজস্ব হিসেবে নগদ অর্থ কিংবা শস্য গ্রহণ করা হতো। নির্ধারিত সময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্য কর্মচারীদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল। তবে প্রজাবৎসল শেরশাহ ফসলের ক্ষতি, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কারণে কৃষকদের খাজনা মওকুফ করতেন, প্রয়োজনবোধে কৃষিঋণও প্রদান করতেন।
শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার
শেরশাহ রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য শুল্ক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। রাজ্যের সর্বত্র চালু বিভিন্ন ধরনের অবৈধ শুল্ক বাতিল করে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনিই একমাত্র শাসন যিনি সীমান্তে ও বিক্রয় স্থানে শুল্ক ধার্য করার রীতি প্রচলন করেন।
কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থার প্রচলন
শেরশাহ কৃষকদের উন্নতিকল্পে কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কবুলিয়ত বলতে কৃষকগণ জমির উপর তাদের অধিকার ও দায়িত্ব বর্ণনা করে সরকারকে যে অঙ্গীকারনামা প্রদান করতো তাকে বুঝায়। আর পাট্টা বলতে সরকার কৃষকদের স্বত্ব স্বীকার করে তাদের যে স্বীকৃতিপত্র প্রদান করতো তাকে বুঝায়।
মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার
শের শাহ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করেন। তিনি মুদ্রা ব্যবস্থার জটিলতা দূর করার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রা বাতিল করে ‘দাম’ নামে এক অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেন। তাছাড়া স্বর্ণমুদ্রাসহ আধুলি, সিকি, এক আনি, দুই আনি প্রভৃতি খুচরা মুদ্রারও প্রচলন করেন।