কেন ছয় দফা মুক্তির সনদ?
ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়। কারণ এই ছয় দফা কর্মসূচির মধ্যেই নিহিত ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার।
পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের যাঁতাকলে পড়ে সমগ্র বাঙালি জাতি যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দিশেহারা, তখন ছয় দফা আনে বাঙালি জাতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের এক অমিয় ধারা। এরই সুধা পান করে সমগ্র বাঙালি সত্তা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে উঠে এবং ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ছয় দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বাঁচার দাবি। পাকিস্তানি শাসন, শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদেরকে মুক্ত করার দাবি। এটা ছিল সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ও বাস্তবভিত্তিক অনুপ্রেরণা সমৃদ্ধ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকতর শক্তিশালী আমলা ও বুর্জোয়া শ্রেণির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের উপর বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা উদীয়মান শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
আরও পড়ুন: খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য
শেখ মুজিবুর রহমান এ কর্সূচিকে বাঙালিদের বাঁচার দাবি বলে উল্লেখ করেন। এ কর্মসূচিকে সামনে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিরা যে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করে পরবর্তীতে তারা এ স্বাধিকার আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পাকিস্তানি শাসকচক্রের কবল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সূর্য। সৃষ্টি হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ফলে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, ছয় দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচির গুরুত্ব তাই অনন্যসাধারণ।
মুক্তির সনদ হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচির সারকথা
১। পূর্ব পাকিস্তান কেবল একটি প্রদেশ নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত এলাকা।ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের হাতেই ন্যস্ত করতে হবে।
২। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান পাহাড় প্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য ‘এক অর্থনীতি’ কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে দু’ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি করতে হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও বাণিজ্যের উপর পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নের পথ সুগম করতে হবে।
৩। পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে।
৪। রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ – এ কথা স্বীকার করে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের ন্যায্য রাজনৈতিক ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে হবে।
অতএব ছয় দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি।
ছয় দফা ও ম্যাগনা কার্টা
ছয় দফাকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল ’ম্যাগনা কার্টা’ এর সাথেও তুলনা করা হয়।
উল্লেখ্য ‘ম্যাগনা কার্টা’ হল ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী রাজার ক্ষমতা খর্ব করে স্বাক্ষরিত এক ঐতিহাসিক দলিল যাকে বর্তমান সাংবিধানিক শাসনের সূচনাও বলা যেতে পারে। উক্ত দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রজাদের অধিকার সংরক্ষিত হয় এবং রাজাও আইনের অধীনে চলে আসে। ভারতীয় সংবিধান এই ম্যাগনা কার্টার ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুদেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ এক পথনির্দেশক দলিল হিসেবে কাজ করেছে।
ছয় দফা যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের অধিকারকে সংরক্ষিত করে, তাই ছয় দফাকে ম্যাগনা কার্টার সাথে তুলনা করা হয়।