Home » প্রচারণা মডেল কি? প্রচারণা মডেলের ফিল্টারসমূহ আলোচনা কর

প্রচারণা মডেল কি? প্রচারণা মডেলের ফিল্টারসমূহ আলোচনা কর

by TRI

মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিপতি ও ক্ষমতাশ্রেণীর পক্ষ হয়ে যে জনমত গঠন ও প্রচারণা চালায়, তাই হল প্রচারণা মডেল । জনতার কাছে প্রচারণা বা বার্তা ও প্রতীক সম্প্রসারণের কাজ করে গণমাধ্যম। মনোরঞ্জন করা, বিনোদন জোগানো, তথ্য জানানো এবং বৃহত্তর সমাজের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোতে খাপ খাওয়ার উপযোগী করে, মূল্যবোধ, বিশ্বারস ও আচরণবিধিতে দীক্ষিত করা গণমাধ্যমের কাজ। এজন্য তারা ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়। যার মধ্যে প্রচারণাও একটি।

Noam ChomskyEdward S. Hermann তাঁদের ‘Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media’ গ্রন্থে প্রচারণা মডেল সম্পর্কে বলেছেনে-

“A propaganda model focuses on the inequality of wealth and power. Its effect on mass media interest and choices.”

প্রচারণা মডেল

‘ইউরোপকে একটি ভূত তাড়া করছে- কমিউনিস্ট ভূত’। এই বাক্য দিয়েই কার্ল মার্কসফ্রেডরিখ এঞ্জেলস ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ লেখা শুরু করেন।

এটা প্রকাশের দেড়শো বছর পর আরেক ভূতের কথা উল্লেখ করেছেন কানাডীয় মিডিয়া পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান। তিনি একটি মিডিয়া সিস্টেমের কথা বলেছেন। আধিপত্যশীল মিডিয়াগুলো এলিট শ্রেণীর স্বার্থে প্রচারণা চালু রাখে। তা অবলোকন করেছেন Noam Chomsky ও Hermann. মিডিয়ার প্রচারণা নিয়ে তারা কথা বলেছেন ‘Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media’ গ্রন্থে।

কিভাবে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিপতি, ক্ষমতাশ্রেণীর পক্ষ হয়ে জনমত গঠন করে, প্রচারণা চালায় তা তারা দেখিয়ে দিয়েছেন। মুনাফালোভী দানবরা কিভাবে নিজেদের মত করে সংবাদ উৎপাদন ও উপস্থাপন করে তারও ব্যাখ্যা করেছেন এই দুই মনীষী। এর জন্য তারা একটি মডেল তৈরী করেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘প্রচারণা মডেল’।

প্রচারণা মডেলের ফিল্টার (ছাকনী)

প্রচারণার কেন দরকার হয়, গণমাধ্যম কার স্বার্থে প্রচারণা অব্যাহত রাখে, এবং তা কীভাবে করে; সে সম্পর্কে প্রচারণা মডেলে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন হারম্যান ও চমস্কি।

তাঁরা বলেছেন, প্রচারণার মূলমন্ত্র হল ৫টি ছাকনী (ফিল্টার)। ছাকনীগুলোর ব্যাখ্যা নিম্নে দেয়া হল-

১) গণমাধ্যমের আকার, মালিকানা ও মুনাফামুখীতা

আধিপত্যশীল গণমাধ্যমগুলোর আকার অনেক বড় হয়। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে (মার্জার) একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হয় এক্ষেত্রে। দৈত্যাকৃতির মিডিয়াগুলো এতই সম্প্রসারিত, আর প্রভাবশালী হয় যে, এরা চাইলেই যেকোন কিছু চাপিয়ে দিতে পারে।

লোভী, স্বার্থান্বেষী, কষাই পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। পুঁজির ধর্মই মুনাফা। কর্পোরেশনগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গণমাধ্যম। এসব কোম্পানীর কর্মপরিধি আর পণ্য বিস্তারের কাজ করে গণমাধ্যম। যেমন- বাংলাদেশে প্রথম আলো, ডেইলী স্টার, এবিসি রেডিও এগুলো ট্রান্সকম গ্রুপের। দেশের প্রভাবশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এগুলো।

এদের কাজ হচ্ছে ট্রান্সকম গ্রুপের বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করা। এসব মিডিয়াগুলো সূক্ষ ও সুসংবদ্ধভাবে ট্রান্সকমের পক্ষে প্রচারণা চালায়, যা সাধারণ পাঠকের পক্ষে বোঝা মুশকিল।

মোটাদাগে, কর্পোরেট শ্রেণীর একচ্ছত্র দালালী, মোসাহেবী করার কাজটিই করে গণমাধ্যম। ব্যবসা, মুনাফা আর টিকে থাকার স্বার্থেই তা করতে হয়।

২) বিজ্ঞাপন: ব্যবসা করার লাইসেন্স

বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রের অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ যেমন বাঁচে না, তেমনি বিজ্ঞাপন ছাড়া সংবাদপত্র/গণমাধ্যম বাঁচে না।

গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বিষয়ক গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় ব্রিটিশ অর্থ দপ্তরের সাবেক চ্যান্সেলর জর্জ লুইসের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন- “বাজার সেইসব পত্রিকার অগ্রগতিতে সহায়তা করবে যারা বিজ্ঞাপনদাতা গোষ্ঠীর কাছে অগ্রাধিকার পায়।”

যেহেতু বিজ্ঞাপন ছাড়া মিডিয়া ব্যবসা সম্ভব নয়, তাই বিজ্ঞাপন দাতা গোষ্ঠীর রুচি ও ইচ্ছনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন সংবাদ প্রকাশ হবে, কোনটি প্রকাশ হবে না। এদের বিরুদ্ধে সংবাদ লেখা তো দূরের কথা।

উদাহরণ- আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো কর ফাঁকি, অনিয়ম, গ্রাহকদের সাথে জোচ্চুরি, প্রতারণা করলেও কোন সংবাদ প্রকাশ করা হয় না। 

আরও পড়ুন:  ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব কি? ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্বের ইতিহাস

অপরদিকে, ভূমিদস্যু, রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলোর ডাহা মিথ্যাবজি প্রচার করে মিডিয়া, শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের স্বার্থে। বাটপার, প্রতারক, শোষণকারী কোম্পানীগুলোর দুষ্কর্ম, কুকর্ম ঢেকে রাখে মিডিয়া। উল্টো এদের পক্ষে সাফাই গায় কোন কোন সময়।

কখনো কখনো দেখা যায়, কোন কোন কোম্পানীর বিরুদ্ধে সংবাদ ছাপছে মিডিয়া। তার মানে, ঐ মাসে বিজ্ঞাপন দেয় নাই ঐ কোম্পানী। আবার, পরদিনই বিজ্ঞাপনের হালুয়া রুটি খেয়ে বিড়ালের মতো চুপসে যায়।

৩) গণমাধ্যমের জন্য সংবাদ উৎপাদন

অর্থনৈতিক চাহিদা ও পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে মিডিয়া তথ্যের শক্তিশালী উৎসের সাথে আপসকামী সম্পর্ক আবদ্ধ।

যেমন- আমরা দেখি গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা না আসলে কোন অনুষ্ঠান শুরু হয় না। কারণ তারা না আসলে প্রচার পাবে না।

তবে প্রশ্ন হল, আগে কি অনুষ্ঠানের দরকার, না প্রচারকর্মীর দরকার। একদিকে প্রচারে ব্যস্ত কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে মিডিয়ার দরকার তথ্যের। এই দুইয়ের সমন্বয়েই দুপক্ষই একে অপরের পরিপূরক। 

৪) হুমকি ধামকি ও এর চর্চাকারীরা

মিডিয়ার কোন বিবৃতি বা অনুষ্ঠানের প্রতি নেতিবাচক সাড়া প্রদানই হল হুমকি ধামকি। এ হুমকিদাতা অনেকেই হতে পারে। কোন ব্যক্তি, এলাকাবাসী, বা ‍বৃহৎ কোন গোষ্ঠী। এদের স্বার্থবিরোধী সংবাদ প্রচার করা হলে প্রতিবেদককে মেরে ফেলা বা হেনস্থা করা ও পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এছাড়া মানহানী বা আদালত অবমাননার হুমকিও থাকে। এসব করে সংবাদ আটকে দেয়ার চেষ্টা করে তাদের পক্ষে সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য করা হয়।

উদাহরণ দেখতে পাই- ‘ডেইলী স্টার’ সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ১৭৮ টি মামলা এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্টার প্রতিনিধির প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ। এছাড়া প্রথম আলোতে ‘রবি’র বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়াও একটি উদাহরণ। অবশ্য এর চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ গেলেই পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হতো। এর বাইরে রয়েছে স্থানীয় মাস্তান, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইত্যাদি।

৫) নিয়ন্ত্রণ কৌশল হিসেবে সাম্যবাদের বিরোধীতা

গণমাধ্যম প্রচারণার সর্বশেষ ফিল্টার হল সাম্যবাদের বিরোধীতা। পৃথিবী দুটো ভাগে বিভক্ত। সাম্যবাদী দুনিয়া আর পুঁজিবাদী দুনিয়া। সম্পদ, পুঁজি আর ক্ষমতা এখন পুঁজিবাদীদের হাতে। আর সাম্যবাদ পুঁজিবাদের মূলে আঘাত করে। সম্পদের মালিকদের ভূতের মত তাড়া করে। তাই পুঁজিপতি, ক্ষমতাশালী, আধিপত্য গোষ্ঠী চায় না তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হোক। তারা চায় গণমাধ্যম সব সময় পুঁজিকে সমর্থন করুক। এজন্য গণমাধ্যম সবসময সাম্যবাদের বিরোধীতা করে। কারণ, পুঁজি বিজ্ঞাপন এনে দেয়, পুঁজি প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখে, সাম্যবাদ যা পারে না। 

তাই আমরা দেখি- মিডিয়া দানব পুঁজিপতি গোষ্ঠীর পক্ষে উলঙ্গ প্রচারণা চালায়। সাম্যবাদের টু শব্দটিও শোনা যায় না।

পরিশেষে, প্রচারণা মডেল থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, মিডিয়ার কাছে কারা মূল্যবান, আর কারা মূল্যহীন। মিডিয়া কার স্বার্থে কাকে বলি দেয়। এছাড়া প্রচারণা মডেল থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, মিডিয়া আসলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রচারযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। মিডিয়ার গঠন প্রকৃতিই তার কারণ।

Related Posts