ছোটগল্প কি বা কাকে বলে?
ছোটগল্প সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রিয় ও মুখ্য মাধ্যম। ছোটগল্পের বিশেষ ধর্ম বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শন। এক কথায় ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্দেশ করা সম্ভব নয়। অনেক অনেক ভাবে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পরস্পর ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আমেরিকার বিখ্যাত গল্পকার ই. এ. পোর-এর মতে,
“যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দু’ঘণ্টার মধ্য পড়া শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে।”
জি. ওয়েলস বলেন, “ছোটগল্প দশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের মধ্য শেষ হওয়া বাঞ্চনীয়।”
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ছোটগল্প “ছোট ও গল্প” হতে হবে।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য
১) নীতি কবিতার মতই ছোটগল্প ব্যঞ্জনাধর্মী এবং জীবনের ঘটনার খন্ডাংশের উপর আলোকপাত করে। মানব জীবনের শত শত বৈচিত্র্যময় মুহূর্তের কোন একটি মাত্র রুপ ছোটগল্পের উপজীব্য।
২) কোন একটি চরিত্রের বিশেষ একটি দিক অবলম্বনে ছোটগল্পকারের বক্তব্যের প্রকাশ ঘটে।
৩) ছোটগল্পের আরম্ভে ও উপসংহারে নাটকীয়তা থাকবে। স্বল্প সংখ্যক সুনির্বাচিত ঘটনার সাহায্যে ইঙ্গিপূর্ণ পরিণতি লাভই ছোটগল্পের উদ্দেশ্য।
৪) নাটকীয়তা, আকর্ষণীয়তা থাকবে ছোটগল্পে। একটি উৎকণ্ঠা ও চরম মুহূর্ত উপস্থিত হবে অনিবার্য হয়ে।
৫) ছোটগল্পে আবশ্যক কথা, ভাষা, ঘটনা বর্জন করা হয়।
৬) ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুরেশচন্দ্র বলেন,
“কবিতা যেমন হৃদয়ের একটা ভাব বা আবেগ প্রকাশের চেষ্টা করে, ছোটগল্প সেইরূপ জীবনের একটা ঘটনা বর্ণনা করার চেষ্টা করে।”
৭) ছোটগল্প সনেটের মত গাঢ়বদ্ধ এবং গীতিকবিতার মত ভাবত্মক হতে হবে।
শিশির কুমার দাসের মতে, ছোটগল্পের চরিত্র সংখ্যা কম, একটি দুটি। ঘটনাও কম, একটি দুটি। এবং সবশেষে একটি চরিত্র বা একটি ঘটনা বা একটি ভাব প্রাধান্য লাভ করে।
পরিশেষে বলা যায়, ছোটগল্প শুধু আখ্যান রচনা নয়, শুধু চরিত্র সৃষ্টি নয়, ছোটগল্প একটি বিশিষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি একটি বিশেষ রুপসৃষ্টি।
আরও পড়ুন: বাংলা বানান সংস্কারের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর
ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ এর অবদান
সত্যি করে বলতে গেলে সাহিত্যে সর্বপ্রথম ছোটগল্পের সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এর হাতে। তার আগে ছোটগল্প তেমন ছিল না। পরে যা হয়েছে তা রবীন্দ্র সমকক্ষ খুবই কম। রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার।
বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে। এরপর ১৮৮৪-৮৫ তে ঘাটের কথা, রাজপথের কথা, ও মুকুট নামে গল্প গুলো প্রকাশিত হলেও ১৮৯০ সালে হিতবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত “দেনাপাওনা” গল্পটিই রবীন্দ্রনাথের তথা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প।
সাহিত্যিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে গল্প রচনায় হস্তক্ষেপ করলেও তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল যে ছোটগল্প তার সূত্রপাত হয় ১৮৯১ সাল থেকে। কবির বয়স তখন ত্রিশ। তখন তার উপর জমিদারির তদারকির ভার অর্পিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. গোলাম মুরশীদের মন্তব্য উল্লেখ করা যায়, ‘ভদ্র চাকুরি বা উপার্জনের একেবারে অনুপযুক্ত বিবেচনায় যখন পৈতৃক জমিদারি তদারকির কাজের দায়িত্ব আসে তার উপর তখন খুশি হওয়া দূরে থাক, তিনি তাকে গণ্য করেন দুর্ভাগ্য এবং নির্বাসন হিসেব। কিন্তু ভাগ্যে শাপে বর হল। পরিবারের বাইরে, আদি সমাজের বাইরে, এমন কি কলকাতার বাহিরে এই প্রথম এক জগৎ প্রত্যক্ষ করেন, যেখানকার নিসর্গ এবং মানুষ তার এক কালের পরিচিত কৃপণ নিসর্গ আর নীরস মানুষ থেকে একেবারে স্বতন্ত্র।’
অসাধারণ বিষয় বৈচিত্র তার ছোটগল্পে গ্রাম, শহর নিয়ে যেমন লিখেছেন তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে অতি প্রাকৃত আবহাওয়ারও সৃষ্টি হয়েছে। তার গল্পে বিচিত্র ধরনের মানুষের কলরবে মুখর রাণী, জমিদার, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র কৃষক, অধ্যাপক, ছাত্র প্রভৃতি। তেমনি আছে প্রকৃতি, প্রেম, ভ্রাতৃস্নেহ, প্রভুর প্রতি আনুগত্য, মাতৃভক্তি। বর্তমান ও অতীত তার গল্পের জমিনে লেপ্টে আছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে ভরপুর। তিনি যেসব আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন-
১) গল্পের কাহিনী নিজে বর্ণনা করেছেন।
২) কাহিনী আরম্ভ করেছেন লেখক, পরে গল্পের নায়ক কাহিনী উত্তম পুরুষে বলে গেছেন। যেমন- নিশীথে।
৩) সম্পূর্ণ কাহিনী উত্তম পুরুষে বর্ণিত। যেমন- অধ্যাপক।
৪) গল্পের কাহিনী চিঠির আকারে লেখা। যেমন- স্ত্রীর পত্র।
৫) কিছু অংশ বর্ণনা কিছু অংশ চিঠি। যেমন- দর্পহরণ।
৬) নাট্যকারে বর্ণিত। যেমন- কর্মফল।
৭) রুপকথার ছলে বর্ণিত। যেমন- একটা আষাঢ়ে গল্প
বিষয়বস্তুর দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্প
১) প্রেমের গল্প
একরাত্রি, সমাপ্তি, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, অধ্যাপক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, রবিবার, পাত্র ও পাত্রী, শেষ কথা, ল্যাবরেটরী ইত্যাদি গল্পে প্রেমের মধুর কোমল বৈশিষ্ট্য।
২) সামাজিক জীবনে বিচিত্র সম্পর্ক
ব্যবধান, মেঘ ও রৌদ্র, পণরক্ষা, দিদি, দান প্রতিদান, কর্মফল, হৈমন্তী, ছুটি, পোস্টমাস্টার, কাবুলি ওয়ালা, দেনা পাওনা ইত্যাদি গল্পে বিচিত্র মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে।
৩) প্রকৃতির সাথে মানব মনের নিবিড় যোগাযোগ
শুভা, অতিথি, আপদ প্রভৃতি গল্পে
৪) অতি প্রাকৃতের স্পর্শ
জীবিত ও মৃত, কঙ্কাল, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ প্রভৃতি গল্পে।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে দু’চারটি চরিত্র ছাড়া আর সবই সাধারণ নর-নারীর। পুরুষ অপেক্ষা নারী চরিত্রের প্রভাব বেশী এবং অধিকতর উজ্জ্বল। বালক বালিকার চরিত্রগুলো বিশেষ সার্থকতার পরিচয় বহন করে।
বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পে উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখনও ঘটেনি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি। সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তিনি আরও বলেন, আমি একটা কথা বুঝতে পারিনে, আমার গল্পগুলোকে কেন গীতিধর্মী বলা হয়। এগুলো নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত কিন্তু তা তো করিনে আমি।
রবীন্দ্রনাথ উচ্চবিত্ত হয়েও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সুখ দুঃখ তুলে এনেছেন। যে শ্রেণীর মানুষকেই তিনি তুলে এনেছেন, তাদেরকেই তিনি দেখেছেন মানুষ হিসেবে, শ্রেণী হিসেবে নয়।
ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ভূদেব চৌধুরী বলেন,
রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ে বাংলা ছোটগল্প প্রথম পূর্ণতা পেয়েছিল। কিন্তু এইটেই বড় কথা নয়। গল্পগুচ্ছের প্রাথমিক যুগের রবীন্দ্র গল্পের মধ্যেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জীবন ভূমি পরিবর্তিত হয়েছে। শিল্পীর জীবনদৃষ্টি পেয়েছে এক অনাবিষ্কৃত জগতে প্রথম প্রবেশিধাকার।
1 comment
Somosto prosno uttor
Comments are closed.