বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুসলিম লীগের ৭ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের তীব্র প্রতিবাদ করে বাংলার সাধারণ মানুষ যুক্তফ্রন্টকে ‘ব্যালট বিপ্লবের’ মাধ্যমে বিজয়ী করে। এ নির্বাচনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও বলা যায়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের কারণ বা পটভূমি
১৯৫৪ সালের নির্বাচন পূর্বের অনেক ঘটনাপ্রবাহের ফল। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের প্রতি চরম অবিচার করতে থাকে। মুসলিম লীগ সরকারের স্বৈরাচারী নীতির কারণে বাঙালিরা চরম হতাশার মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের’ সময় পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে নিহত হলে মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি জনগণের প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। শেরে বাংলার নেতৃত্বে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’, মাওলানা হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী লীগ’, মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে ‘নেজামে ইসলামী’ ও হাজী দানেশের নেতৃত্বে ‘বামপন্থী গণতন্ত্রী দল’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন। নির্বাচনে তাদের প্রতীক ছিল ‘নৌকা’।
আরও পড়ুন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, গুরুত্ব ও ফলাফল
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি
যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এ দফাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা,
২) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ করা,
৩) পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করা,
৪) সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা,
৫) পূর্ব পাকিস্তানে লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা,
৬) কারিগর মাহাজিরদের কাজের ব্যবস্থা করা,
৭) বন্যা ও দূর্ভিক্ষ রোধের জন্য খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করা,
৮) পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প-কলকারখানা গড়ে তোলা,
৯) অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা,
১০) শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা,
১১) ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা,
১২) শাসন ব্যয় হ্রাস করা ও মন্ত্রীদের বেতন এক হাজার টাকার বেশি না করা,
১৩) দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা,
১৪) জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি বাতিল করা,
১৫) বিচার ও শাসন বিভাগ পৃথকীকরণ করা,
১৬) বাংলা ভাষা গবেষণার জন্য ‘বর্ধমান হাইসে’ বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা,
১৭) রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে নিহত শহীদদের স্মৃতি মিনার নির্মাণ করা,
১৮) ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করা,
১৯) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা,
২০) আইন পরিষদের মেয়াদ কোনো অজুহাতেই বৃদ্ধি না করা,
২১) পরিষদের কোনো সদস্যপদ খালি হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল
১৯৫৪ সালের নির্বাচন মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক আইন সভার সর্বমোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২৩৬টি আসন পায়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ১০টি আসন পায়, কংগ্রেস ২৪টি, তফসিলী ফেডারেশন ২৭টি, খেলাফত রব্বানী পার্টি ১টি, খ্রিস্টান ১টি, বৌদ্ধ ২টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি এবং স্বতন্ত্র ৫টি আসন লাভ করে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিকাশ এ নির্বাচনের মাধ্যমেই ঘটে। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। এ নির্বাচনে বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। এ নির্বাচন বাঙালির সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।