Home » হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন?
হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন,

হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন?

by TRI

হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলার কারণ

হোসেন শাহী বংশই বাংলার স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেছিল। হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৪)।  ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হাবশী রাজাদের অত্যাচারে প্রজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে হাবশী সুলতান শামসউদ্দিন মুজাফ্ফর শাহকে হত্যা করা হয়। রাজ্যের প্রধানগণ আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে সুলতান নিযুক্ত করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আবির্ভাবের ফলে বাংলাদেশে হাবশী শাসনের অবসান ঘটে। 

হোসেন শাহী বংশের গৌরব

প্রাক-মুঘল যুগে হোসেন শাহী আমল ছিল বাংলার স্বর্ণযুগ। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার শ্রেষ্ঠ স্বাধীন সুলতান ছিলেন। তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক বিস্ময় চরিত্র। হোসেন শাহ স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে হাবশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে উজির সৈয়দ হোসেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি ধারণ করে স্বীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সময়ে বাংলাদেশের সীমানা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়।

১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পঁয়তাল্লিশ বৎসর ধরে হোসেন শাহী বংশ বাংলাদেশে রাজত্ব করেন। এ বংশে চারজন সুলতান রাজত্ব করেন। এরা হলেন-

১) আলাউদ্দিন হোসেন শাহ

২) নাসির উদ্দীন নসরত শাহ

৩) আলাউদ্দিন ফীরুজ শাহ

৪) গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ

হোসেন শাহী সুলতানগণ ছিলেন যুদ্ধে কুশল এবং শাসনে সাধারণ প্রজার কল্যাণকামী। সে সময় বাঙালি প্রতিভার বহুমুখী বিকাশ ঘটে। হোসেন শাহের সময়ই বাংলাদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। রাজ্য জয়ের ক্ষেত্রেও হোসেন শাহী বংশ কৃতিত্ব ও গৌরবে সমুজ্জ্বল।

শাসনকাল

হোসেন শাহী আমল বাংলাদেশের সুলতানী আমলের স্বর্ণযুগ বলে বিবেচিত হয়। এই বাংলার ৪ জন সুলতান মোট ৪৫ বছর রাজত্ব করেন। হোসেন শাহ হাবশীদের দমন করেন এবং প্রয়োজনে হাবশীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেন। দেশকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করেন। শেষ দিকে গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের লোভের ফলে শান্তি বিঘ্নিত হয়। অবশ্য এর ফলে বংশের স্বাধীনতাও লোপ পায়। কিন্তু এর আগে পর্যন্ত শান্তি বজায় ছিল এবং দেশের অগ্রগতি হয়।

আরও পড়ুন:  শশাঙ্ক কে ছিলেন? বাংলার প্রথম নরপতি হিসাবে শশাঙ্কের কৃতিত্ব মূল্যায়ন

রাজ্য বিস্তার

হোসেন শাহী আমলে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রধান প্রমাণ বাংলার বাইরে রাজ্য বিস্তার। হোসেন শাহ চতুর্দিকের সীমান্ত রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধের কোনটিই বাংলার মাটিতে হয়নি। এতে প্রত্যেক যুদ্ধেই কিছু কিছু সামানা বৃদ্ধি পায়। হোসেন শাহ কামতা, কামরূপ, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা ও চট্টগ্রাম জয় করেন। দিল্লীর সুলতান সিকান্দর লোদীর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য হন। প্রায় অর্ধেক বিহার গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকাল পর্যন্ত বাংলার সুলতানের অধীনে থাকে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতি

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই সময়ে বাংলার উন্নতি ঘটে। হোসেন শাহী আমলের অনেক শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই আমলের শিলালিপির সংখ্যা সুলতানী আমলের শিলালিপির থেকে অনেক বেশী। এতে বোঝা যায় যে, এই আমলে মসজিদ, মাদরাসা, খানখাহ, ব্রিজ, জলাশয় ইত্যাদি অধিক পরিমাণে নির্মিত হয়। আর্থিক উন্নতি না হলে প্রাতিষ্ঠানিক নির্মাণে এত ব্যয় সম্ভব হত না। এই সময়ে পর্তুগিজরা বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশে আসে। পর্তুগিজ পরিব্রাজকের বিবরণীতে দেখা যায় যে, প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য এবং শিল্পপণ্য উৎপাদিত হত, শিল্পের মধ্যে বস্ত্র শিল্প ছিল অনেক উন্নত। পর্তুগিজ ছাড়াও ইরানি, আরবীয় ও পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব বণিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল।

ধর্ম ও নিষ্ঠা

হোসেন শাহী সুলতানেরা সকলে নিষ্ঠাবান ছিলেন। তারা মুসলমান সূফী সাধকদের ভক্তি, শ্রদ্ধা করতেন। তাদের সম্মানে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানখাহ নির্মাণ করেন। সূফীদের মাজার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ শয়খ নূর কুতুব আলমের মাজারে লঙ্গারখান চালু রাখেন ও মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমিদান করেন। তিনি শয়খ নূর আলমকে এত শ্রদ্ধা করতেন যে, প্রতি বৎসর পায়ে হেঁটে রাজধানী একগলা থেকে পান্ডুয়ায় এসে দরগাত জিয়ারত করতেন। রাসূল (সা:) এর পদচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য হোসেন শাহ একটি মঞ্চ নির্মাণ করেন। নরসত শাহ কদম রাসূল নামে একটি সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ বদর শাহ নামক একজন পীরের ভক্ত ছিলেন। এই পীরের নামানুসারে তিনি বদর শাহ উপাধি নেন।

শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা

হোসেন শাহী আমলে সুলতানেরা বিদ্বান ছিলেন এবং বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময়ে সৈয়দ মীর আলভী ফারসী ভাষায় “হেদায়েত-উর-বামী” নামে ধনুবিদ্যা সম্পর্কে একখানি বই লেখেন এবং সুলতানের নামে উৎসর্গ করেন। হোসেন শাহের রাজধানী একডালায় বসে মুহাম্মদ বিন ইয়া “সহীহ বুখারী” অনুলিখন করেন। তিনি সুলতানের প্রশংসা করেন। সুলতান নসরত শাহের আদেশে আহমদ মজল্লদ খান “ইস্কান্দার নামা” নামক পুস্তক ফারসি ভাষায় লেখেন এবং সুলতানের নামে উৎসর্গ করেন।

হোসেন শাহী সুলতানেরা আরবি ও ফারসি ভাষার সাথে সাথে বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি কবিদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বাংলা ভাষায় প্রথম কবি শাহ মুহাম্মদ সঁগীর তার “ইউসুফ জোলেখা” সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ এর সময়ে লেখেন।

ধর্ম নিরপেক্ষতা

হোসেন শাহী সুলতানগণ দিল্লির রাষ্ট্রের সীমানা সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেন। বিদেশী বংশোদ্ভূত সামরিক শাসকগণ মুখ্য প্রশাসক ছিল বটে, কিন্তু প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে যোগাযোগের জন্য স্থানীয় ব্রাক্ষ্মণ ও কায়স্থদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ করেন। সরকারের উচ্চপদে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হিন্দুদের নিয়োগ দেয়া হত।

রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সম্প্রসারণ

এ বংশের প্রথম দুই সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও নসরত শাহ বাংলার রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। এ আমলে বাংলার সীমান পশ্চিমে ত্রিহূত দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যার কিয়দংশ, উত্তর পূর্বে কুচবিহার ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

উদার শাসন ব্যবস্থা

হোসেন শাহী বংশের সুলতানেরা এক উদার শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। এই বংশের সুলতানেরা হিন্দুদের উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। হোসেন শাহের সময়ের অনেক উচ্চপদস্থ হিন্দু রাজ কর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ উজীরের মর্যাদায় নিযুক্ত ছিলেন। সনাতন নামের দুই ভাই হোসেন শাহের প্রিয়পাত্র ছিল। রুপ ছিলেন প্রধান সচিব এবং সনাতন ছিলেন সাকের মালিক। রুপ ও সনাতনের অনেক আত্মীয়ও উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন। হোসেন শাহের দেহরক্ষীদের নেতাও ছিলেন কেশর ছত্রী নামক একজন হিন্দু। এতে বোঝা যায়, হোসেন শাহী সুলতানেরা হিন্দু রাজ কর্মচারীদের কিরুপ বিশ্বাস করতেন।

আরও পড়ুন:  মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা পর্যালোচনা কর

শিল্প ও স্থাপত্য

স্থাপত্য শিল্পেও হোসেন শাহী সুলতানেরা মূল্যবান অবদান রাখেন। সেই আমলে নির্মিত হয় ছোট ও বড় সোনা মসজিদ। কদম রসূল ভবন এবং আরো অনেক মসজিদ সুলতানদের কীর্তি বহন করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মা-হুয়ান একাধিক শিল্পীর কথা উল্লেখ করেন। যদিও তাদের শিক্ষার নিদর্শন সম্পর্কে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। রাজ দরবারে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যথেষ্ট প্রচলন ছিল। স্বর্ণ, রৌপ্য, মুদ্রা থেকে নানা ধরণের হস্তলিপির পরিচয় পাওয়া যায়। এ যুগে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। গৌড়ের সোনা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ উল্লেখযোগ্য।

জনকল্যাণমূলক কাজ

জনকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে হোসেন শাহী সুলতানেরা মূল্যবান অবদান রাখেন। অনেক রাস্তা ও পুল নির্মাণ করেন এবং অনেক জলাশয় খনন করেন। জলাশয়গুলো বীরভূম, বর্ধমান জেলায় খনন করা হয়। এছাড়া হোসেন শাহী আমলে সুলতানেরা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে তাদের শাসন ব্যবস্থাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছিলেন।

শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বিদ্রোহী হাবশীদের সমূলে বিতাড়িত করেন। দেহরক্ষীদের বহিষ্কার করে নতুন দেহরক্ষীর দল গঠন করেন। এভাবে তিনি ও তার পরবর্তী শাসকগণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। যার ফলে হোসেন শাহী আমলে বাংলায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় ছিল।

হোসেন শাহী আমল যথার্থই স্বর্ণযুগ

হোসেন শাহী আমলকে যথর্থভাবে বাংলা স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ আমলকে স্বর্ণযুগ বলার পিছনে নিম্নের বিষয়গুলো জড়িত-

  • হোসেন শাহী আমলের সুলতানেরা প্রশাসন ও সামরিক ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
  • এ রাজ বংশের শাসনকালে বাংলার রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে।
  • এই যুগে মুসলিম সমাজের ‍উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি ঘটেছিল এবং সূফি মতবাদ প্রসার লাভ করেছিল।
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং শাসক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য চর্চার উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
  • হোসেন শাহী আমলে বাংলার সাথে ইউরোপীয়দের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল এবং পর্তুগীজরাই প্রথম বাণিজ্যের জন্য বাংলায় আগমন করে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, হোসেন শাহী সুলতানেরা অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করেন, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন এবং অখন্ডতা বজায় রাখেন। এছাড়া দেশে শিল্প সাহিত্যের প্রসার ঘটান, উদার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং হিন্দু মুসলিম সকলকে রাজ্যের উচ্চপদে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেন। হোসেন শাহী আমলে বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল কর্মকান্ডে উন্নতি ঘটে। তাই হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয়।

Related Posts