(শশাঙ্ক – ১ম পর্বের পরে)
রাজ্যবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সংঘর্ষ
প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুর পর তার জৈষ্ঠ্য পুত্র রাজ্যবর্ধন সিংহাসন আরোহণ করেন। অতঃপর বোন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারের জন্য কনৌজের দিকে অগ্রসর হলে দেবগুপ্তের সাথে তার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দেবগুপ্ত পরাজিত ও নিহত হন। কিন্তু কনৌজের উপর নিজ প্রভূত্ব বিস্তার করার আগেই শশাঙ্কের সাথে তার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন নিহত হন। রাজ্য বর্ধনকে শশাঙ্ক ন্যায় যুদ্ধের দ্বারা হত্যা করেন কি না এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এ সম্বন্ধে সমসাময়িক তথ্যের মধ্যে বাণভট্টের হর্ষচরিতে উল্লেখ আছে যে, গৌড়ের রাজার মিথ্যা উপাচারে আশ্বস্থ হয়ে নিরস্ত্র রাজ্যবর্ধন একাকী গৌড়ের রাজার ভবনে গমন করেন। এবং তৎ কর্তৃক নিহত হন। কিন্তু এর ঐতিহাসিক ভিত্তি সুস্পষ্ট নয়।
সমসাময়িক চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণীতে স্পষ্টতার প্রভাব রয়েছে। তার বর্ণনায় এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, শশাঙ্কের মন্ত্রীবর্গ রাজ্যবর্ধনকে এক সভায় আমন্ত্রণ করে তাকে হত্যা করেন। অন্যত্র হিউয়েন সাং লিখেছেন যে, রাজ্যবর্ধনের মন্ত্রীবর্গের দোষেই রাজ্যবর্ধন শত্রুর হাতে নিহত হন। মন্ত্রীরাই এর জন্য দায়ী। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে, বাণভট্টের উক্তি ও হিউয়েন সাং এর বিবরণীতে কোন মিল নেই।
হর্ষবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সংঘর্ষ
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন সিংহাসন আরোহণ করেন। এবং শশাঙ্ককে শাস্তি দান ও পৃথিবী গৌড়শূন্য করবার শপথ নিয়ে বিপুল সমর সজ্জায় সজ্জিত হতে থাকেন। হর্ষবর্ধন স্বসৈন্য অগ্রসর হয়ে পথিমধ্যে সেনাপতি ভন্ডির নিকট শুনতে পেলেন যে, তার বোন রাজ্যশ্রী কারাগার থেকে পালিয়ে বিন্ধ্যা পর্বতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরপর হর্ষবর্ধন ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে গঙ্গা নদীর তীরে নিজ সৈন্যদের সাথে মিলিত হন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে এটা জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কিছু সাফল্য তিনি পেয়েছেন। কিন্তু অবশেষে তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী মূলকল্প গ্রন্থে শশাঙ্কের পরাজয়ের কথা থাকলেও ঐতিহাসিক আর.সি. মজুমদার ও স্মীথ মনে করেন যে, তাতে শশাঙ্কের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।
আরও পড়ুন: মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা পর্যালোচনা কর
শশাঙ্কের ধর্মমত
শশাঙ্ক শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তার সময়ে মুদ্রার মুখ্যতলে মহাদেব তথা শিবের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ এবং গৌণতলে শিবের কন্যা লক্ষীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে। শৈব ধর্মাবলম্বী হিসাবে শশাঙ্ক স্বভাবতেই শৈব ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং তার এ পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু হিউয়েন সাং শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচারের গল্প লিপিবদ্ধ করেছেন।
শশাঙ্কের চরিত্র ও কৃতিত্ব
সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক একটি বিশিষ্ট নাম। তার সম্বন্ধে যদিও আমরা খুব অল্পই জানতে পার তবুও প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি তিনিই ছিলেন এ কথা বললে ভূল হবে না। নিম্নে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি তুলে ধরা হলো-
- বাঙালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা: শশাঙ্ক হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি পরবর্তী গুপ্ত রাজগণের শাসন হতে গৌড় রাজ্যকে স্বাধীন করে এক শক্তিশালী সার্বভৌম বাঙালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
- রাজ্য বিস্তার: উচ্চাভিলাষী শশাঙ্ক কেবলমাত্র গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ক্ষান্ত হন নি। তিনি এর সীমানা ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।
- গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি: শশাঙ্ক গৌড় রাজ্যকে স্বাধীন করে একে উত্তর ভারতের এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
- দক্ষ শাসক: শশাঙ্ক কেবল মাত্র রাজ্য বিস্তার কাজেই ব্যস্ত ছিলেন না। বরং রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি বিজিত রাজ্যে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং শাসনকার্যে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন।
- সুচতুর কুটনীতিবিদ: শশাঙ্ক তার কুটনৈতিক পারদর্শীতার মাধ্যমে কনৌজের চিরশত্রু মৌখরি রাজবংশের ধ্বংস সাধন করেন। তিনি তার কুটনৈতিক বলেই সমসাময়িক শক্তিশালী সম্রাট হর্ষবর্ধনের মোকাবেলাতেও নিজ প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, শশাঙ্ক প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একজন স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক ছিলেন। তিনি বাংলার বাইরেও তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি আর্যবর্তের বাইরেও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। সর্বোপরি, বাংলার রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বাংলার হস্তক্ষেপে শশাঙ্কের অবদান অস্বীকার করা যায় না।