ব্যক্তি জীবনে লোকপ্রশাসন
আধুনিক সমাজে লোকপ্রশাসন অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। যখন একটি স্বতন্ত্র কর্ম পদ্ধতি বা পাঠ্য বিষয় হিসেবে লোকপ্রশাসনের কোন অস্তিত্ব ছিল না, তখনও সমাজে বসবাসকারী মানুষ নিজেদের অজান্তেই লোকপ্রশাসনের উপর নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং বলা যায় যে, লোকপ্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা অতি প্রাচীন কাল থেকেই অনুভূত হয়ে আসছে। আধুনিক যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি, শিল্প-কারখানার প্রসার, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কাজের ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতা – ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে লোকপ্রশাসন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং ব্যক্তির আন্তর্জাতিক জীবন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব আরোপ করে। বলা যেতে পারে যে, ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লোকপ্রশাসনের ভূমিকা রয়েছে। এমনকি শিশুর মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন সময় থেকে শুরু করে মৃত্যুর পরবর্তী সময় পর্যন্তও লোক প্রশাসন তার নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। সরকারি হাসপাতালে প্রসূতির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে অনাগত শিশুর যত্ন নেওয়া হয়, শিশু জন্ম লাভ করার পর জন্ম রেজিষ্ট্রারে তালিকাভূক্তিকরণ, শিশুর শিক্ষা জীবন শুরু করা এবং শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিক্রম করে সর্বোচ্চ শিক্ষা ডিগ্রী লাভ করা, কর্মজীবন শুরু করা ও পারিবারিক জীবনে প্রবেশ, কর্ম জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করা ও অবসর জীবনকালীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ এবং অবশেষে মৃত্যু বরণ করার পর মৃত্যু জনিত সার্টিফিকেট প্রদান, তার মৃতদেহের সৎকার করা পর্যন্ত – ব্যক্তি জীবনের সামগ্রিক বিষয়ই লোকপ্রশাসনের দ্বারা প্রভাবিত।
মানব সভ্যতায় লোকপ্রশাসন
মানব সভ্যতার সফলতা ও ব্যর্থতাও লোকপ্রশাসনের উপর নির্ভরশীল। চার্লস এ. বিয়ার্ড মানব সভ্যতায় লোকপ্রশাসনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন যে, “ সভ্যতা নির্ভর সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সভ্য সমাজের কার্যাবলি পরিচালনা করতে সক্ষম আমাদের সেই দক্ষতার উপর যার দ্বারা একটি দর্শন, বৈজ্ঞানিক ভিত এব সঠিক প্রশাসনিক চর্চার ধারা বিকশিত করা সম্ভব।” (The future of civilized government, and even I think, of civilization itself rests upon our ability to develop a science and philosophy and a practice of administration competent to discharge the function of civilization of civilized society.)
রাষ্ট্র পরিচালনায় লোকপ্রশাসন
কেবল ব্যক্তি জীবন ও মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে লোকপ্রশাসনের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও লোকপ্রশাসনের সমান গুরুত্ব রয়েছে।
বর্তমান রাষ্ট্র আর পুলিশি রাষ্ট্র নয়, বর্তমান রাষ্ট্র জনগণের তথা দেশের উন্নয়নের সার্বিক দিক দেখাশুনা করে। জনগণের কল্যাণ করতে যেয়ে সরকারকে জনগণের মৌলিক অধিকার যেমন – অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, নিরাপত্তা ইত্যাদি কাজ করতে হয়। আর এ কাজগুলো সফলতার সাথে করে থাকে সরকারের নির্বাহী বিভাগ। কাজেই আমরা বলতে পারি কল্যাণমূলক কাজ করতে হলে লোক প্রশাসন পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কল্যাণমুখী নীতি নির্ধারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন মন্ত্রীরা করে থাকলেও তাদেরকে নীতি নির্ধারণে এবং দক্ষতার সাথে নীতি বাস্তবায়নে সাহায্য করে থাকে আমলারা, যারা প্রশাসনের লোক। সুতরাং বলা যায় যে, আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সফলতা বহুলাংশে প্রশাসনিক দক্ষতা ও জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। সরকার যত উন্নত নীতিই নির্ধারণ করুক না কেন তার সফল প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে প্রশাসনিক দক্ষতা ও জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় জীবনের সফলতা লোকপ্রশাসনের উপর নির্ভরশীল।
দেশের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথভাবে বণ্টনের মাধ্যমে জনকল্যাণ করাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাজ। এই কাজগুলো সফলতার সাথে করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কেননা তা তথ্য ও তত্ত্বগত জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। লোকপ্রশাসন পাঠের মাধ্যমে তত্ত্বগত জ্ঞান অর্জন করা যায়। কাজেই লোকপ্রশাসন পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে লোকপ্রশাসন
অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে লোকপ্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। লোকপ্রশাসন বিষয়ে শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদান বিভিন্ন দেশের শিক্ষা কর্মসূচীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচিত। পাঠ্য বিষয় হিসেবে প্রশাসন বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নগামী দেশের কলেক ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে একটি চিত্তাকর্ষক ও আবশ্যকীয় বিষয় রুপে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রশাসন বিদ্যার দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, হল্যান্ড এবং এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা পেয়েছে। লোকপ্রশাসনকে বিশদভাবে জানা, বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য প্রশাসনিক গবেষণা কেন্দ্র ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। লোকপ্রশাসনের দ্রুত বিকাশের মূলে রয়েছে এর শিক্ষাগত প্রয়োজন ও ব্যবহারিক পদ্ধতি ও প্রশাসনিক তত্ত্বের প্রয়োগ।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন শাস্ত্র হিসেবে লোকপ্রশাসন বিশেষভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। লোকপ্রশাসন শিক্ষার মাধ্যমেই প্রশাসনিক তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করা যায়। প্রশাসন একটি নৈপুণ্য যা কেবল বিরামহীন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন পেশাগত প্রশাসন, সামাজিক এবং শিল্প ও কর্মচারী সংক্রান্ত প্রশাসন এবং প্রায়োগিক বিষয়ে প্রশাসন।
১৯৬৯ সালের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধীনে লোকপ্রশাসনকে একটি গ্রুপ হিসেবে চালু করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে লোক প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত ভর্তি ও নির্ধারিত আসন সংখ্যা অবশ্য চাহিদার তুলনায় অতি নগন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ১৯৭৩ সালে রাজনীতি বিজ্ঞানের অধীনে একটি গ্রুপ হিসেবে লোকপ্রশাসন বিভাগ খোলা হয়েছে যা ১৯৮০ সালে একটি স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভ করে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও রাষ্ট্রনীতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগ রয়েছে। ১৯৯০ সালে এ বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। এখানে দুটি বিভাগের কোর্সের সমান সমান প্রাধান্য রয়েছে। একমাত্র এখানেই এখনও বিভাগ দুটি পৃথক করা হয়নি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিকাল স্টাডিজ এন্ড পাবলিক এফেয়ার্স বিভাগ থেকে বের হয়ে এসে লোকপ্রশাসন নামে পৃথক বিভাগ যাত্রা শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ফলে লোকপ্রশাসনে অনেক নতুন পাঠ্যক্রম সংযোজিত হয়েছে।
প্রশাসনিক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPATC), বাংলাদেশ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (BIAM) ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল একাডেমী ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট (NAEM), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানজমেন্ট (BIM) প্রভৃতি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লোকপ্রশাসন অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করেই এগুলো করা হচ্ছে।
পরিশেষে প্রফেসর ডব্লিউ. বি. ডানহামের উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করব। তিনি লোকপ্রশাসন পাঠের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে বলেছিলেন, “আমাদের সভ্যতা যদি কোন দিন ধ্বংস হয়, তবে তা হবে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য।”