Home » সমাজবিজ্ঞানের ক্রিটিক্যাল মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর। লোকপ্রশাসনের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা পরীক্ষা কর।

সমাজবিজ্ঞানের ক্রিটিক্যাল মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর। লোকপ্রশাসনের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা পরীক্ষা কর।

by TRI

Brian Fay সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় সর্বজনীন মডেল Interpretive Model কে ভিত্তি করে সামাজিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত তৃতীয় আরেকটি মডেল দাঁড় করান। Brian Fay নিজেই মনে করেন তৃতীয় এ মডেলটি বিশ্লেষণ ও সমালোচনার উর্ধ্বে সৃষ্টি এবং সমাজ বিজ্ঞান দর্শনের ভবিষ্যৎ বিতর্কের মূল উপজীব্য বিষয়। সমাজ বিজ্ঞানের নতুন এই মডেলটি ক্রিটিক্যাল মডেল (Critical Model) l

ক্রিটিক্যাল মডেলটি মূলত সোশ্যাল থিওরি এর প্রকৃতি অনুযায়ী থিওরি এবং প্র্যাকটিস এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।

ক্রিটিক্যাল মডেল প্রকৃতপক্ষেই Critical, এই মডেলটি থিওরিগুলোকে সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এবং মানুষের চাহিদা ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য থিওরিগুলো বাস্তবতার সাথে কতটা প্রাসঙ্গিক তাও বিবেচনা করে।

ক্রিটিক্যাল মডেল এর উৎপত্তি:

ইউরোপে বার্নস্টেইনের নেতৃত্বে সংস্কারবাদী আন্দোলনের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় যাদের চিন্তাধারার মূল বৈশিষ্ট্য ছিলো ক্রিটিক্যাল ফিলোসফি। এ দর্শনের মাঝে যতটুকু না মার্কসীয় দর্শনের উপস্থিতি তার চেয়ে বেশি নব্য হেগেলীয় দর্শনের সমালোচনাধর্মীতা। নব্য হেগেলপন্থীরা পুরাতন হেগেলপন্থীদের বিশ্ব আত্মার ধারণার স্থলে আত্মসচেতনাতাকে মূলধন করে এক বিশেষ সংস্করণের জন্ম দেন।

কথা বলতে শিখুন - ওয়াহিদ তুষার | Kotha Bolte Shikhun

TK. 400 TK. 320 You Save TK. 80 (20%)

মূলত Brian Fay এ মডেলের জন্য মার্ক্স এর Social Theory এবং Neo-Marxist Frankfurt school এর মধ্যে কোনরূপ সমন্বয় করার চেষ্টা করেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন মার্ক্স এর সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স (Critical Social Science) এর আদর্শস্বরুপ।

ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স এর বৈশিষ্ট্য:

তিনটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্সকে আলাদা করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রিটিক্যাল মডেল এর অনুশীলনকারীরা (Practitioner) গ্রহণ করেছেন। এসব অনুশীলনকারীরা সামাজিক কাঠামো ও উন্নয়নের কোন নির্দিষ্ট তত্ত্ব বা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারণাকে পূর্ব হতে স্বীকার করে নেননি।

প্রথম বৈশিষ্ট্য: ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স সমাজবিজ্ঞানে ইন্টারপ্রেটিভ ক্যাটাগরির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে। এটাকে একটা বিজয় হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য সমাজ বিজ্ঞানীদেরকে অবশ্যই এ্যাক্টরদের মন-মানসিকতা, ইচ্ছা এবং সেই সাথে সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী তাদের নীতি, সাংবিধানিক ধারণাগুলোকেও বুঝতে হবে।

মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা ও সমস্যা থেকেই এই থিওরির উদ্ভব। এজন্য ক্রিটিক্যাল তত্ত্ববিদরা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এ্যাক্টরদেরকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, যা ছিল তাদের প্রথম পদক্ষেপ।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য: এই বৈশিষ্ট্যে বলা হচ্ছে, ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স এমন একটি থিওরি যা সামাজিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে মানুষের কার্যকলাপগুলো বোঝে। যেগুলোর উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অর্থাৎ এই মডেলটি সামাজিক সম্পর্কসমূহের পদ্ধতিগুলোকে উন্মোচন করার পথ অনুসন্ধান করে।

এই মডেলের তত্ত্ববিদরা নির্দিষ্ট সমাজের প্রেক্ষিতে সামাজিক আচরণ এর কার্যগত আইন আবিষ্কার ও অনুসন্ধান করে।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য: তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যা কিনা প্রতিষ্ঠিত ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এ তত্ত্বটি বিভিন্ন সামাজিক অনুশীলন (Social Practice) এর সাথে জড়িত। এবং থিওরি ও প্র্যাক্টিস এর মাঝে সমন্বয় সাধনের সূচনালগ্ন হিসেবে এটাকে ধরা হয়।

মানুষের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সন্তুষ্টির উপর ভিত্তি করে এই মডেলটি তার জ্ঞানকে ধারণ করে। এর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে থিওরি এর সাথে প্র্যাক্টিস এর সংশ্লিষ্টতার উপর।

ক্রিটিক্যাল মডেল এর মূল বিষয়বস্তু:

এই তত্ত্বটির মূল ব্যাখ্যায় Brian Fay প্রথমেই জানতে চেয়েছেন সামাজিক অনুশীলনগুলো কিভাবে সামাজিক বিজ্ঞান এর তত্ত্বে অন্তর্ভূক্ত হল। এ হল এমন যুক্তি যেখানে সামাজিক দ্বন্ধ গুলো নিয়ে Brian Fay পূর্বেই আলোচনা করেছেন। সেই সাথে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন তর্কযুক্তির মাধ্যমে তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন।

ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স তার কাজের সত্যতা বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য বিভিন্ন কার্যগত আইন ও সামাজিক দ্বন্ধগুলো বর্ণনা করে এবং এ্যাক্টররা যা অনুভব করে সমাজ বিজ্ঞানীরা তা পর্যবেক্ষণ করে।

এই তত্ত্বটি আর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়েছে তা হল সোশ্যাল এ্যাক্টরদের চাহিদা ও উদ্দেশ্যর অপরিপূর্ণতার উপর। এ ধরণের অ্যাপ্রোচগুলো সবসময় এ্যাক্টরদের অনুভূত চাহিদা এবং কষ্টগুলোকে ব্যাখ্যা করে।

ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিক ও ইন্টারপ্রিটিভ তাত্ত্বিকরা উভয়েই মনে করেন মানুষের ইচ্ছা, ধ্যান-ধারণা ও আত্ম-উপলব্ধির উপর তারেদ কার্যক্রমগুলো নির্ভর করে। আর এজন্যই তাত্ত্বিকদেরকে মানবিক আচরণ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হবে। তারা এক্ষেত্রে শিল্পোন্নত দেশগুলোর নারীদের অসন্তুষ্টিগুলো প্রকাশ করতে আগ্রহী। Brian Fay অসন্তুষ্টি বুঝিয়েছেন এভাবে-

পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে উৎপাদন ও বন্টনের আমূল পরিবর্তনের কারণে নারীদের শ্রম ধীরে ধীরে গৃহকেন্দ্রীক হয়ে উঠে। ফলে নারীদেরকে সবধরণের বাইরের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। মনে করা হত, তারা পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা সৃষ্টি করছে। যার ফলে উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

সমাজ জীবনে সৃষ্ট এ ধরণের হাজারো সমস্যা দূরীকরণে ক্রিটিক্যাল থিওরি threefold manner way মেনে চলে।

প্রথম উপায়: উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হয় সে সম্পর্কে এ তত্ত্ব জ্ঞান দিবে। সর্বোপরি কোন কাজটি অধিক সন্তুষ্টি এর সাথে করা যায় তাও শেখাবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি শিশুর পরিপূর্ণ বয়স হলে বাবা-মা তাকে স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তা করে। তা তাদের নিকট তখন সন্তুষ্টির বিষয়। অপরদিকে শিশুটি বাবা-মাকে ছেড়ে নতুন পরিবেশের কথা ভেবে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়। 

দ্বিতীয় উপায়: ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল থিওরি একটি Ideological Critique প্রক্রিয়া। বিভিন্ন বাঁধা অতিক্রম করে তা বাস্তবিক রুপ লাভ করে। এটি এ্যাক্টরদের বোঝাতে চেষ্টা করে তাদের আত্ম-উপলব্ধিগুলো ত্রুটিপূর্ণ এবং তারা কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে। এই মডেলটি প্রকৃতপক্ষে তারা যা চায় তা কিভাবে অর্জন করতে পারে তা দেখায়। এক্ষেত্রে বাবা-মা শিশুটিকে স্কুল সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেন। শিশু বুঝতে পারে তার ধারণা ত্রুটিপূর্ণ এবং স্কুল থেকে সে বাস্তবে তার জীবন গঠনের শিক্ষা নিবে। স্কুল তার লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তি গড়ার পথ নির্দেশ করে।

তৃতীয় উপায়: এ পর্যায়ে মডেলটি বাঁধার সম্মুখীন হয়। তত্ত্ব ও অনুশীলন এর মাঝে যেমন তফাৎ, তেমনি ব্যক্তি জীবনে চলার পথে ব্যক্তির ধ্যান-ধারণা ও বাস্তব ঘটনাসমূহের মাঝেও অনেক পার্থক্য। সমাজ বিজ্ঞান সচেতনতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে কিছু সুস্পষ্ট শর্ত, নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস সৃষ্টি করে।

এক্ষেত্রে শিশু যা ভেবে প্রথম ভয় পায়, স্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস করার পর সে ভীতি কেটে যায়। এখানেই তার ধারণা ও বাস্তবতার তফাৎ।

থিওরি ও প্র্যাক্টিসকে বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য দুটো উপায়ের কথা Brian Fay উল্লেখ করেন, যেগুলো একে অপরের পরিপূরক।

প্রথমত, সমাজ জীবনের অংশ হিসেবে যে সব তত্ত্বের উৎপত্তি হয়, ক্রিটিক্যাল মডেল সেগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকে। Brian Fay এগুলোকে “Educative Role” বলে অভিহিত করেছেন। Educative Role হল সমাজ বিজ্ঞানীরা এ্যাক্টরদেরকে একটি বিষয় সম্পর্কে জানাবে কিন্তু সে বিষয়টি নিয়ে এ্যাক্টর নিরপেক্ষভাবে তার মত করে চিন্তা করবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানীরা এ্যাক্টরদের আত্ম-সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রেষণা দেবে।

দ্বিতীয়ত, ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স আধা-কার্যকারণ আইনগুলোকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করেন। Brian Fay এখানে “Expert Role” এর কথা উল্লেখ করেন। এক্সপার্ট রোল যারা পরিচালনা করে তার হল নীতি বিশেষজ্ঞ।

নীতি বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখেন। তার এ্যাক্টরদের অনুভূত চাহিদাগুলো কিভাবে পূরণ করা যায় তা অনুসন্ধান করেন এবং প্রথম থেকেই এ্যাক্টররা যাতে এগুলোকে টেকনিক্যালি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেভাবেই তাদেরকে পরিচালিত করেন।

সমাজ বিজ্ঞানের ক্রিটিক্যাল মডেল অনুসারে সামাজিক তত্ত্বগুলো শুধুমাত্র সমাজ কাঠামোর চিত্রই তলে ধরে না বরং সেই সাথে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন জটিলতার মাঝেই থেকে সামাজিক তত্ত্বগুলো পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবেও কাজ করে।

লেখক এই মডেলটি প্রদানের সময় সামাজিক আচরণ অনুধাবনে বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক ধারণাগুলোও ব্যাখ্যা করেছেন। এ ধারণাগুলো কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত।

আরও পড়ুন:  লোকপ্রশাসনে বিশ্বায়নের প্রভাব

লোকপ্রশাসন এবং ক্রিটিক্যাল মডেলের সংশ্লিষ্টতা:

ক্রিটিক্যাল থিওরির বিশেষজ্ঞদের মত লোকপ্রশাসকদেরকেও নীতি নির্ধারণ এবং নীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হয়।

লোকপ্রশাসন বলতে আমরা বুঝি, যে প্রশাসনটি জনগণের জন্য কাজ করে। অর্থাৎ একটি সমাজের জনগণ যেমন লোকপ্রশাসনের আলোচ্য বিষয় তেমনি ক্রিটিক্যাল মডেলেরও আলোচ্য বিষয় হল সমাজের জনগণ।

ক্রিটিক্যাল মডেলে যেমন প্র্যাক্টিস ও থিওরি এর মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয় তেমনি লোকপ্রশাসনও সমাজের মানুষের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নীতি তৈরির সময় সামাজিক পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

কাজেই এটা স্পষ্ট যে, লোকপ্রশাসনে ক্রিটিক্যাল মডেলটির প্রতিনিয়ত চর্চা হচ্ছে।

 

Related Posts