Home » সরকারি নীতি কি? সরকারি নীতি প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা।
সরকারি নীতি প্রণয়ন

সরকারি নীতি কি? সরকারি নীতি প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা।

by TRI

সকল রাষ্ট্র তাদের মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য নানা প্রকার নীতি গ্রহণ করেন। নীতি হল যে কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচীকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য এবং নিয়ন্ত্রণ করার ভিত্তি। নীতিবিহীন পরিকল্পনা ও কর্মসূচী সমাজে দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ আনতে পারে না। তাই বর্তমান বিশ্বের যে কোন শাসন ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। সরকার যে সব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যাদি সম্পন্ন করে, তা সরকারি নীতির মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

সরকারি নীতি

জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কৌশল নির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রের সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত জনস্বার্থ সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহকেই সরকারি নীতি বলা হয়। এই নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশের সংবিধান মূল নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। নীতি একটি ন্যায় সঙ্গত, সুপরিকল্পিত কার্যব্যবস্থা বিশেষ। এটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাঝামাঝি পদক্ষেপ। ব্যাপক অর্থে, কোন কার্য পরিকল্পনায় কি পরিবর্তন কিংবা কি সংযোজন করা হবে তা পূর্ণ কর্তৃত্বের মাধ্যমে নির্ধারণ করাকেই সরকারি নীতি বলা হয়।
Dimock এর মতে, ‘সরকারি সিদ্ধান্তকে পরিচালিত করার জন্য স্বীকৃত আচরণের নিয়মকেই নীতি বলে।’
Thomas R. Dye এর মতে, “Public Policy is whatever government chooses to do or not to do.”
মোটকথা, সরকারি নীতি বা জননীতি হল জনগণের জন্য সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণীত ন্যায় সঙ্গত, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিত কার্যব্যবস্থা যা সরকার ও জনগণকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এক কথায় বলা যায়, বর্তমানের আলোকে এবং ভবিষ্যতকে সামনে রেখে সরকারিভাবে যে পদ্ধতি প্রণয়ন বা নির্ধারণ করা হয় তাকে সরকারি নীতি বলে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সরকারি নীতির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ পাওয়া যায়। যথা-

  • সরকারি নীতি সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়।
  • এটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাঝামাঝি পদক্ষেপ।
  • নীতির সাথে বহুরকমের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার প্রশ্ন জড়িত থাকে।
  • নীতি প্রণীত হয় দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূর প্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
  • এটা তথ্য নির্ভর ও এর একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া

১। সমস্যা চিহ্নিতকরণ:- নীতি প্রণয়নের প্রথম ধাপে সরকারি কাজের চাহিদাসমূহ উল্লেখ থাকে।
২। নীতি গঠনের প্রস্তাব:- এই পর্যায়ে সরকারি প্রস্তাবিত কর্মসূচীসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজানো হয়।
৩। নীতি বৈধকরণ:- এই পর্যায়ে প্রস্তাবসমূহের বাছাইকরণ, প্রস্তাবসমূহের রাজনৈতিক সমর্থনদান এবংসংসদ কর্তৃক বৈধতা আনয়ন করা হয়।
৪। নীতি বাস্তবায়ন:- নীতি ব্যাখ্যাকরণ, আমলাতন্ত্রকে সংগঠিতকরণ, অর্থ ও সেবা সরবরাহ, সমন্বয় সাধন ও বাস্তবায়ন করা হয়।

৫। নীতি মূল্যায়ন:- এই পর্যায়ে কর্মসূচী বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হয়।

নীতি প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা

সরকারি নীতি অনেকাংশেই জটিল ও প্রযুক্তি বিদ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আইনসভার সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপেশাদার। সে কারণে ক্রমবর্ধমান হারে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে থাকে। নিম্নে চিত্রের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া তুলে ধরা হল:-

সরকারি নীতি কি
                                   চিত্র: নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া

সরকারি নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হল-

১) প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণে আমলা

যদিও নীতির প্রণয়নের ব্যাপারে মন্ত্রীরাই সর্বোচ্চ ব্যক্তি; তথাপি সরকারি কাজের স্বার্থে সচিবকে নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত ব্যাপারে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। কারণ প্রশাসনিক কাজে মন্ত্রীরা অজ্ঞ। তারা সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদে আসেন আবার চলে যান। কিন্তু প্রশাসনের আমলারা অনেকদিন নিয়োজিত থাকেন। ফলে তারা অভিজ্ঞ হন। নীতি নির্ধারণ করা মন্ত্রীদের দায়িত্ব বটে কিন্তু অভিজ্ঞতার কমতির কারণে ও প্রশাসনিক কাজে অজ্ঞতার কারণে মন্ত্রীদেরকে আমলাদের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। তাই দেখা যায়, নীতি প্রণয়নে আমলারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

২) তথ্য সংগ্রহ ও পরামর্শ প্রদান

আমলারা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে মন্ত্রীদের কাজে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ প্রশাসনিক কাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কর্মকর্তাদের চিরাচরিত নিয়ম বা কর্তব্য হল প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও এ ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নিকট উপস্থাপন করা। মন্ত্রীরা আমলাদের পরামর্শ ও অভিযোগ শোনেন, তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সুতরাং আমলারা তথ্য সংগ্রহ ও পরামর্শ প্রদান করে নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

৩) সংসদীয় নীতি নির্ধারণে আমলা

সংসদীয় নীতি নির্ধারণের ৩টা ক্ষেত্র আছে। সেগুলো হল-
ক) আইন প্রণয়ন:
আইনসভা বিভিন্ন কারণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। কোন কোন সময় জনগণের চাহিদা থেকেও তা করা হয়। আবার কোন কোন সময় নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্যও তা করা হয়। নীতিত প্রণয়নের কারণ যাই হোক না কেন এই ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। আইন প্রণয়নে আমলারা দুটি ধাপে কাজ করে থাকে।
  • আইনের খসড়া প্রণয়ন: আইনের খসড়া বিল প্রণয়ন একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমলারা প্রস্তাবিত খসড়া প্রস্তাব থেকে শুরু করে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগের সাথে আলাপ-আলোচনা এবং তাদের সাথে ঐক্যমত্যে পৌঁছান, কেবিনেটের অনুমোদন নেওয়া এবং চূড়ান্ত খসড়া বিলে যে সমস্ত বিষয়াদি অন্তর্ভূক্তির প্রয়োজন, তার কারণসসহ বিশদ বিবরণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কাজপত্র আইন মন্ত্রণালয়ে ‍পাঠানো ইত্যাদি সকল কাজ আমলাদের করতে হয়।
  • আইন প্রণয়নে সংসদীয় পর্যায়: সংসদীয় পর্যায়ে বিলটি উপস্থাপনের দায়িত্ব মন্ত্রীর। সত্যিকার অর্থে যে কোন বিলের বিষয়াবলী নির্ধারণ করেন আমলাবৃন্দ। আমলারা সংসদীয় পর্যায়ে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারেন না। আমলারা সংষদ অধিবেশন চলাকালে মন্ত্রীদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করেন, আবার কখনো বা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেন যাতে মন্ত্রীদের কোন অসুবিধা না হয়।
খ) সংসদে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান:
সংসদে প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তা করা হয় আমলাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। তথাপি এ ব্যাপারে মন্ত্রীরা আমলাদের সাহায্য ছাড়া অগ্রসর হতে পারেন না। বিরোধী দলের সদস্যগণ মন্ত্রীদের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, সরকারি আয়-ব্যয়সহ অন্যান্য বিষয়ে নানা প্রকার প্রশ্ন করে থাকেন। এই সকল প্রশ্নের উত্তরের জন্য মন্ত্রীদেরকে আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়।
গ) বাজেট প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা:
সরকারি বাজেট প্রণয়নে মন্ত্রীদের পুরোপুরি আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় দু’টি স্তর আছে। যথা-
  • প্রস্তুতিমূলক স্তর: সচিবগণ তাদের স্ব স্ব বিভাগের ও মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় সব ব্যয় নির্ধারণ করে থাকেন ও যাচাই করে থাকেন। তারা স্ব স্ব মন্ত্রীদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে বাজেট পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করে থাকেন। প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেট অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। অর্থমন্ত্রণালয়ের আমলাগণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবিত বাজেটের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন কাজ সম্পাদন করেন। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের পর বাজেটটি কেবিনেটে পাঠানো হয়। কেবিনেটে অনুমোদন লাভের পর বাজেটটি অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপন করেন। তাই বলা যায়, বাজেট প্রস্তুত করার পিছনে আমলাদের সর্বাধিক ভূমিকা থাকে।
  • সংসদীয় স্তর: এই পর্যায়ে সংসদে উত্থাপিত বাজেটের প্রস্তাবিত আয়-ব্যয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অর্থমন্ত্রীকে কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তার মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য অফিসের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। মন্ত্রীদের এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, নীতি বাস্তবায়নে আমলারা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

৪) পরিকল্পনা প্রণয়ন

সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিকল্পনা কমিশন থাকলেও পরিকল্পনার জন্য বা পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ, সংগ্রহ করে থাকে আমলারা। অতএব, এই ব্যাপারে আমলাদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য।

৫) নীতি বাস্তবায়ন

সরকারির সকল নীতির বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমলাদের। কারণ নীতি বাস্তবায়নের জন্য যে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন তা কেবল মাত্র আমলাদেরই রয়েছে। দায়িত্ব পালনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

৬) গণসংযোগ নীতি

বর্তমান সময়ে গণসংযোগ নীতি সরকারের সফলতা পরিমাপের একটি বিশেষ মাধ্যম। আমলাদের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও কর্মদক্ষতার উপর একটি নির্বাচিত সরকারের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে। আমলারা বিভিন্ন জনসংযোগ নীতির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম জনসম্মুখে তুলে ধরে সরকারি নীতির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালান।

৭) রাজস্বনীতি নির্ধারণ

মূলত আমলারাই সরকারের রাজস্বনীতি নির্ধারণ করেন। সরকারের কোন খাতে কত রাজস্ব ধরা হবে, কিভাবে আদায় করা হবে, সরকারি আয়-ব্যয়, ঋণ ইত্যাদি নীতিমালা আমলারাই প্রস্তুত করে থাকেন।

৮) অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি

পুঁজি, বিনিয়োগ, মূলধন গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। এসব ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে দেশের তাত্ত্বিক জ্ঞান সম্পন্ন আমলারা।

উপসংহার

প্রশাসনিক সংস্কার, প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও বাজেট প্রণয়ন প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্ত্রীদেরকে আমলাদের উপর সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করতে হয়। বস্তুতঃ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ ও নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমলারা দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

Related Posts