নৃবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু
নৃবিজ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর বিস্তৃত পরিধিতে নৃবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো মানুষ ও তার সংস্কৃতি। এছাড়াও নৃবিজ্ঞানের আলোচনায় রয়েছে এর বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা। মানুষের শরীর সম্পর্কীয় আলোচনা করতে গিয়ে এটি মানব জীবাশ্মবিজ্ঞান, তুলনামূলক মানব শারীরবিদ্যা, মানবদেহ পরিমাপ বিদ্যা, হাড়বিদ্যা, মনুষ্য জীববিজ্ঞান প্রভৃতি নিয়ে অলোচনা করে। অন্যদিকে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক আলোচনা করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞান মানুষের জীবনপ্রণালী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, আইন-কানুন, প্রথা, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা, আদর্শ প্রভৃতি দিকের আলোচনা করে। এছাড়া নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুতে মানবজাতির ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ, ভৌগোলিক কারণে ভাষার বিভিন্নতা, বিভিন্ন সম্প্রদায় প্রভৃতির আলোচনা রয়েছে।
নিম্নে নৃবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হলো:
১. মানবদেহ নিয়ে আলোচনা
নৃবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো মানুষ। বিশেষ করে মানবদেহ নিয়ে এর আলোচনা বিস্তৃত। মানুষের দেহের গড়ন, কাঠামো, দৈহিক পরিবর্তন, প্রকৃতি প্রভৃতি নিয়ে নৃবিজ্ঞান আলোচনা করে। নৃবিজ্ঞান মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন- চুলের ধরন, দাঁতের গড়ন, ত্বকের রং, রক্তের চাপ প্রভৃতি দিকের যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশলের মাধ্যমে নির্ভুল পরিমাপ করে থাকে।
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও |
২. বংশগতি ও উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা
নৃবিজ্ঞানের আরেকটি আলোচনার বিষয়বস্তু হলো মানুষের বংশগতি ও উত্তরাধিকার। এটি মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ প্রাণিজগতের একটি অংশ এবং বিবর্তনের ধারায় বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। এজন্যই নৃবিজ্ঞানে একে নৃতাত্ত্বিক বংশগতিবিদ্যা বলা হয়।
৩. ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা
নৃবিজ্ঞান মানবজাতির ভাষাতত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করে। ভাষার মাধ্যমে একটি জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। এটি সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা। ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ, ভাষার কাঠামো, গোষ্ঠীর ভাষার তুলনা, ভাষার সংকেত প্রভৃতি ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। নৃবিজ্ঞান ভাষা সংক্রান্ত সকল বিষয় আলোচনা করে কোন জাতির রীতিনীতি ও ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারে।
৪. মানবজাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনা
মানুষের উৎপত্তি, বিবর্তন, আদিম ও আধুনিক মানুষের বিভিন্নতা প্রভৃতি বিষয় নৃবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। জীবজগতের অংশ হিসেবে নৃবিজ্ঞান এসব নিয়ে গবেষণা করে। এছাড়া প্রাণিরাজ্যে মানুষের স্থান কোথায় তা খুঁজতে গিয়ে মানুষ ও প্রাণীর পার্থক্য খুঁজে দেখার চেষ্টা করে।
৫. জ্ঞাতি সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা
মানুষের জ্ঞাতি সম্পর্কের আলোচনা নৃবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। বংশগত বা রক্তসম্পর্কীয়, বৈবাহিক, কাল্পনিক ও প্রথাগত যে ধরনের জ্ঞাতি সম্পর্ক হোক না কেন এক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্তের বন্ধন, বিবাহ, দত্তক গ্রহণ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠার ব্যাপারে জাতির ভূমিকা পালন করা নৃবিজ্ঞানের আলোচনাভুক্ত।
৬. মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা
নৃবিজ্ঞান মানুষের সংস্কৃতির বিকাশ, অর্থাৎ সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান, পরিবার, বিবাহ, বিশ্বাস, ধর্ম, আচার, জ্ঞাতিপ্রথা, আইন, সরকার, আদর্শ, মূল্যবোধ প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। এককথায় নৃবিজ্ঞান সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনপ্রণালী আলোচনা করে।
৭. সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা
সমাজস্থ মানুষের সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে নৃবিজ্ঞান আলোচনা করে। পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের সভ্যতার আবিষ্কার, শিল্পকলা, ধাতবদ্রব্য প্রভৃতির আলোচনা নৃবিজ্ঞান করে থাকে। এগুলো থেকে আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায়। এভাবে সাত হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে।
৮. প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনা
মাটি খুঁড়ে মানুষের কঙ্কাল, ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র, হাতিয়ার প্রভৃতি সংগ্রহ করে এগুলোর শ্রেণীবন্যাস ও মূল্যায়ন করে অতীত ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা নৃবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয়। এ সম্পর্কিত গবেষণাকে বলা হয় প্রত্নতত্ত্ব।
৯. সামাজিক কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা
সমাজস্থ মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন, দল ও তাদের কার্যাবলি আলোচনা করা নৃবিজ্ঞানের অন্যতম বিষয়বস্তু। এর ফলে নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা- প্রশাখাও বিস্তৃতি লাভ করেছে।
১০. অর্থনৈতিক দিকের আলোচনা
নৃবিজ্ঞান মানুষের অর্থনৈতিক দিক নিয়েও আলোচনা করে। অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো উৎপাদন, বণ্টন, সঞ্চয়, লগ্নি, বিনিময়, হস্তান্তর, মালিকানা প্রভৃতি নৃবিজ্ঞান মানুষের অর্থনৈতিক অভাব বা চাহিদা মিটানোর জন্য প্রচেষ্টা চালায়।
১১. সম্পত্তির উত্তরাধিকার
নৃবিজ্ঞান মানুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে মর্গান বলেছেন, “আদিম সমাজে তেমন কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। মৃত্যুর পর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ধ্বংস করা হতো এবং পরবর্তীতে তা গোত্রের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। এক সময় মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বন্টনের রীতি চালু হয়।” এসবই নৃবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
১২. বর্ণবাদ সম্পর্কিত আলোচনা
মানবগোষ্ঠীতে ‘উচ্চ ও নিচু’ নামে দুটি ভাগ রয়েছে। এদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের উচ্চ এবং বাকিদের নিচু বলে অভিহিত করা হয়। বর্ণবাদীদের মতে, শেতাঙ্গরা উৎকৃষ্ট, বুদ্ধিমান, শাসক, শক্তিশালী এবং বাকিরা শাসিত, দাস, মূর্খ, দুর্বল ও অনাথ। বর্ণবাদের এসব দিক নৃবিজ্ঞান আলোচনা করে।
১৩. মানবকল্যাণ সম্পর্কে আলোচনা
মানবকল্যাণে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগানো এর অন্যতম আলোচ্যবিষয়। অন্যকথায় বলা যায়, নৃবিজ্ঞান মানুষের সমস্যার সমাধান চায়। ফলিত নৃবিজ্ঞানীরা দুর্বল জনগোষ্ঠী সম্পর্কে উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে। এজন্য ১৯৪১ সালে আমেরিকায় সমিতি গঠন করা হয়।
নৃবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর |
১৪. জাতিবিদ্যা
জাতিবিদ্যা বলতে আদিম সমাজের প্রথা ও সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনাকে বুঝায়। নৃবিজ্ঞানে এ সম্পর্কিত আলোচনা হলো আদিম সমাজে রক্ত সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবন, সংস্কার, ধর্ম, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক তৎপরতা প্রভৃতি।
১৫. শিল্পকলা ও সাহিত্য
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান শিল্পকলা ও সাহিত্যের আশ্রয় নিয়ে থাকে। এগুলো সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। নৃবিজ্ঞান শিল্পকলা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার ফলে সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
উপর্যুক্ত আলোচনায় নৃবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে মানবজাতির সার্বিক দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। “নৃবিজ্ঞান মানুষের সামগ্রিক পাঠ” হোবেলের একথাটি নৃবিজ্ঞানের আলোচনায় পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, নৃবিজ্ঞান মানুষের দৈহিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল দিক নিয়েই আলোচনা করে।