ভগবান বুদ্ধের অভিনব আবিষ্কার এ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (The Noble Eight-fold Path)! এটাই দুঃখমুক্তির একমাত্র উপায়। ছয় বৎসর কঠোর তপস্যার ফল- চতুরার্য সত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এসব তিনি বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে উপলব্ধি করেছিলেন। এ মার্গ অনুসরণ করলে মানুষ সর্বদুঃখের অন্তসাধন করে পরম সুখকর নির্বাণ সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। এ মার্গ বা পথকে দুই অন্ত বর্জিত মধ্যম প্রতিপদা বলা হয়। এ মার্গ সাধনায় যেমন অত্যধিক কৃচ্ছসাধনের প্রয়োজন নেই, তেমনি ভোগস্পৃহার সহজতৃপ্তি সাধনও এখানে অনুপস্থিত। এ দুই অন্তই অষ্টাঙ্গ মার্গ সাধনার উপযোগী নহে।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আট প্রকার। যথা- ১. সম্যক দৃষ্টি, ২. সম্যক সংকল্প, ৩. সম্যক বাক্য, ৪. সম্যক কর্ম, ৫. সম্যক আজীব বা জীবিকা, ৬. সম্যক ব্যায়াম বা উদ্যম, ৭. সম্যক স্মৃতি ও ৮. সম্যক সমাধি।
১. সম্যক দৃষ্টি (Right Perspective)
সত্য বা অভ্রান্ত দৃষ্টি। এটা দুই প্রকার- লৌকিক সম্যক দৃষ্টি এবং লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি।
ক) লৌকিক সম্যক দৃষ্টি: পাপ ও পাপের হেতু এবং পুণ্য ও পুণ্যের হেতু সম্বন্ধে বিশুদ্ধ জ্ঞান হল সম্যক দৃষ্টি। প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার ইত্যাদি অকুশল কাজগুলো করলে পাপ হবে- এটা সম্যকরূপে জানা সম্যক দৃষ্টি। এদের হেতু লোভ-দ্বেষ-মোহ, এ জ্ঞান সম্যক দৃষ্টি ।এ সমস্ত অকুশল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে- এটা জানা সম্য নষ্ট। তাই অলোড, অদ্বেষ ও অমোহ জ্ঞান হল- লৌকিক সম্যক দৃষ্টি।
খ) লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি: চার আর্যসত্যে জ্ঞান ও ব্রিলক্ষণ জ্ঞান হল লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি। চার আর্যসত্য হল- দুঃখে জ্ঞান, দুঃখের হেতু তৃষ্ণা -এ জ্ঞান, দুঃখের বিনাশ বা নিরোধে জ্ঞান এবং দুঃখ বিনাশের উপায় জ্ঞান। ত্রিলক্ষণ জ্ঞান হল- পঞ্চস্কন্ধে অনিত্য-দঃখ-অনাত্ম জ্ঞান। রূপ বা দেহ অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম, বেদনা অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম, সংজ্ঞা অনিত্য- দুঃখ-অনাত্ম, সংস্কার অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এবং বিজ্ঞান অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম।
আরও পড়ুন:
পারমী কি? থেরবাদ ও মহাযান ধর্মমতে পারমী কয়টি ও কি কি? তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।
২. সম্যক সংকল্প (Right Aspiration)
সৎ সংকল্প। এটা দ্বিবিধ- লৌকিক সম্যক সংকল্প এবং লোকোত্তর সম্যক সংকল্প। নিষ্কাম সংকল্প হল সম্যক সংকল্প। রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ ইত্যাদি কাম তৃষ্ণামূলক চিন্তা বর্জনের সংকল্প। অপরের অমঙ্গল চিন্তা বর্জনের সংকল্প বা মৈত্রী চিত্ত উৎপাদনের সংকল্প। আবার হত্যার ইচ্ছা বর্জনের সংকল্প বা করুণাচিত্ত উৎপাদনের সংকল্প। এ ত্রিবিধ সংকল্প লৌকিক সম্যক সংকল্প। আট প্রকার লোকোত্তর চিত্তে উঃপন্ন সংকল্পই লোকোত্তর সম্যক সংকল্প। স্রোতাপত্তি মার্গ চিত্ত ও ফলচিত্ত, সমৃদাগামী মার্গচিত্ত ও ফলচিত্ত, অনাগামী মার্গচিত্ত ও ফলচিত্ত এবং অরহত্ব মার্গচিত্ত ও ফলচিত্ত- এগুলো আট প্রকার লোকোত্তর চিত্ত। নির্বাণকে অবলম্বন করে উৎপন্ন হয় বলে এদেরকে লোকোত্তর চিত্ত বলা হয়।
৩. সম্যক বাক্য (Right Speech)
সৎ বা সুভাষিত বাক্য। চার প্রকার অকুশল বাক্য-মিথ্যা বাক্য, পরুষ বাক্য (কর্কশ বাক্য), পিশুন (বিভেদ সৃষ্টিকর) বাক্য ও সম্প্রলাপ (বৃথাবাক্যালাপ) ব্যতীত যে বাক্য শ্রুতিমধুর, যা ধর্মসম্মত, কালোপযোগী ও নির্দোষ এটাই সম্যক বাক্য।
৪. সম্যক কর্ম (Right Action)
সৎ বা পবিত্র কর্ম। প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা কথন, মাদক দ্রব্য সেবন বর্জিত যে কর্ম এসব সৎকর্ম। সর্বপ্রকার অকুশল কর্ম বর্জন করে সর্বপ্রকার কুশলকর্ম সম্পাদন করাই হচ্ছে সম্যক কর্ম।
৫. সম্যক আজীব বা জীবিকা (Right Livelihood)
সৎবা পবিত্র জীবিকা। শীলসম্মত উপায়ে জীবিকা আহরণই সম্যক জীবিকা। কায়িক ও বাচনিক পাপে লিপ্ত না হয়ে যে জীবিকা অর্জন করা হয়- এটাই সম্যক জীবিকা। অস্ত্র, প্রাণী, মাংস, মাদক দ্রব্য ও বিষ- এ পাঁচ প্রকারের ব্যবসা পরিহার করে কৃষি, বাণিজ্য, চাকুরী ইত্যাদি সৎ জীবিকা দ্বারা স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ করা সম্যক জীবিকা।
৬. সম্যক ব্যায়াম বা উদ্যম (Right Effort)
সৎ প্রচেষ্টা বা সৎ উদ্যম। চার প্রকারে দৃঢ় পরাক্রম সহকারে যে প্রচেষ্টা -এটাই সম্যক ব্যায়াম বা উদ্যম। যেমন-
১. উৎপন্ন পাপ বিনাশের জন্যে উদ্যম বা প্রচেষ্টা।
২. অনুৎপন্ন পাপ উৎপন্ন না করার প্রচেষ্টা।
৩. অনুৎপন্ন পুণ্য উৎপন্ন করার প্রচেষ্টা।
৪. উৎপন্ন পুণ্য রক্ষা ও বৃদ্ধির চেষ্টা।
৭. সম্যক স্মৃতি (Right Mindfulness)
কুশল আলম্বন পুনঃ পুনঃ স্মরণ করার নামই স্মৃতি। অকুশল বিষয় মনে উঠা স্মৃতি নহে। স্মৃতি কুশল অবস্থাকে সর্বদা জাগ্রত রাখে। সৎকর্ম অপরিত্যাগই এর লক্ষণ। অপ্রমাদ এর কৃত্য। স্মৃতি সর্ববিধ কুশল কর্মে বর্তমান। স্মৃতিবিহীন চিত্ত কর্ণধার বিহীন তরণীর ন্যায় বিপদগ্রস্ত। এ স্মৃতি চার প্রকার- কায়ানুদর্শন বেদনানুদর্শন, চিত্তানুদর্শন ও ধর্মানুদর্শন। এ কায় অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম। এটা আমার নহে, এটা আমার আত্মা নহে ইত্যাদি। এরূপ বেদনা, চিত্ত ও ধর্ম অনুদর্শনে ও প্রযোজ্য।
৮. সম্যক সমাধি (Right Concentration)
চিত্তের সম্যক স্থৈর্যকে সমাধি বলা হয়। চিত্তের একাগ্রতা সাধনই সমাধি। সাধারণতঃ চিত্ত চঞ্চল ও ইতস্ততঃ বিচরণশীল। এ চিত্রকে সংযত করতে না পারলে জগতে কোন কাজই সিদ্ধ হয় না। বিক্ষিপ্ত চিত্তে সদ্ধর্ম দর্শন অসম্ভব। সকল প্রকার কুশল কর্ম সমাধিমুখী, সমাধির দিকে ধাবমান এবং সমাধিতে স্থিত থাকে। সমাধিস্থ ব্যক্তিই যথাযথ জ্ঞাত হন। এ সমাধি চার প্রকার। যথা- প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চতুর্থ ধ্যান। প্রথম ধ্যানে বিতর্ক, বিচার, প্রীতি, সুখ ও একাগ্রতা চিত্তের এ পাঁচটি অবস্থা বর্তমান থাকে। দ্বিতীয় ধ্যান প্রাপ্তির সংগে সংগে বিতর্ক ও বিচার উপশান্ত হয়। চিত্তে বলবতী শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। তৃতীয় ধ্যান লাভে বিতর্ক, বিচার ও প্রীতির অবসান হয়। চতুর্থ ধ্যানে উপেক্ষার প্রাধান্য- অত্যধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এ চতুর্থ ধ্যানচিত্ত পরমার্থ জ্ঞান লাভের উপযোগী।
প্রখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক ডক্টর রীস্ ডেবিট্স্ বুদ্ধের এ চতুরার্য সত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে বলেছেন, “Buddhist or non-Buddhist, I have examined everyone of the great religious systems of the world and in none of them have I found anything to surpass, in beauty and comprehensiveness, the Noble Eight-fold Path and the four Noble thruths of the Buddha. I am content to shape my life according to that Path.” আমি বিশ্বের বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ সব বড় বড় ধর্মীয় বিধি-বিধানসমূহ পরীক্ষা করে দেখেছি। সৌন্দর্য ও ধীশক্তির ব্যাপকতার নিরিখে বুদ্ধের আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও চতুরার্য সত্যকে অতিক্রম করার মত কোনকিছু অন্য কোনখানে আমি খুঁজে পাইনি। ঐ মার্গানুসারে আমার জীবন গঠন করে আমি পরিতৃপ্ত। (Buddhism in the eyes of intellectuals by K. Shri Dhammananda, Page-21)