ন্যায়পালের প্রকারভেদ
নিয়োগ পদ্ধতি ও জবাবদিহিতার দিক দিয়ে ন্যায়পালের ২ টি ভাগ লক্ষ্যণীয়। যথা-
১.আইন বিভাগীয় ন্যায়পাল
২.শাসন বিভাগীয় ন্যায়পাল
আইন বিভাগীয় ন্যায়পাল
ন্যায়পাল যখন আইনসভা কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত হয় এবং নিজ কার্যাবলীর জন্য আইন সভার নিকট দায়বদ্ধ থাকে তখন তাকে আইন বিভাগীয় ন্যায়পাল বলে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশে আইন বিভাগীয় ন্যায়পাল বিদ্যমান।
শাসন বিভাগীয় ন্যায়পাল
যখন ন্যায়পাল দেশের শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয় এবং শাসন বিভাগের নিকট দায়বদ্ধ থাকে তখন তাকে শাসন বিভাগীয় ন্যায়পাল বলে। নাইজেরিয়ায় এরূপ ন্যায়পাল বিদ্যমান। শাসন বিভাগীয় ন্যায়পাল প্রশাসন কর্তৃক নিযুক্ত বিধায় কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
ন্যায়পালের নিয়োগ
ন্যায়পালের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩টি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যথা-
১.আইনসভা কর্তৃক নির্বাচনের মাধ্যমে
২.নির্বাহী প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক
৩.আইনসভার অনুমোদন সাপেক্ষে
এক্ষেত্রে প্রথম ও তৃতীয় পদ্ধতি গুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দ্বিতীয় পদ্ধতিটি সর্বাধিক খারাপ বলে বিবেচিত।
ন্যায়পাল হিসেবে তাকেই নিয়োগ দেওয়া উচিত যিনি সমাজে নন্দিত ও যার নিরপেক্ষতার বিষয়ে সমাজের প্রায় সকলে একমত থাকে। সাধারণত প্রবীণ আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সম্মানীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: ন্যায়পাল কি? ন্যায়পাল কিভাবে উৎপত্তি লাভ করে?
ন্যায়পাল পদের যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা
একটি দেশে দূর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ সরকার পরিচালনার জন্য ন্যায়পাল প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক দেশের বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সদা সতর্ক থাকে।তা স্বত্ত্বেও একটি দেশে ”ন্যায়পাল” কেন থাকতে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। নিম্নে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হল:
প্রথমত: আদালত ব্যবস্থা সকল ধরণের বিরোধ নিষ্পত্তি সহ প্রতিকার দিয়ে থাকলেও প্রায় সকল দেশের আদালতগুলোই দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করতে ব্যর্থ হয়।বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, একটি সাধারণ মামলার চূড়ান্ত ফলাফল পেতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। ফলে মানুষ বছরের পর বছর আদালতে দৌঁড়ানোর বাড়তি যাতনা এড়াতে নিরবে অধিকার লঙ্ঘন সয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত: আদালতে মামলা মোকাদ্দমা অনেক ব্যয়বহুল। কোর্ট ফি, বিভিন্ন স্ট্যাম্প ফি, আইনজীবীর ফি ইত্যাদি খরচ বহন করা খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয় বিধায় জনগণ সহজে আদালতে যেতে চায় না।
তৃতীয়ত: আদালত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকারের ঘোষণা দিলেও প্রতিকার দিতে ব্যর্থ হয়।কারণ প্রতিকার অনেক ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর নির্ভর করে।
চতুর্থত: আদালত বা ট্রাইব্যুনাল যদি কোন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে সতর্ক হয়, তথাপি প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য তা আর সম্ভব হয় না।কারণ প্রশাসনের মতামত, রিপোর্ট ইত্যাদি অপরিহার্য হলেও প্রশাসনের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কিংবা বাদীকে হয়রানি করার জন্য প্রশাসন অহেতুক দেরী করে।এ কারণে জনগণ প্রশাসনিক কোন বিষয় নিয়ে মামলায় পড়াতে চায় না।
পঞ্চমত: প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণকারী সংস্থাগুলো স্বাধীন নয়। মূল প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকায় এগুলো কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না।
যেমন- বাংলাদেশে কোন মন্ত্রণালয়ের ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে গেলে উক্ত মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। অনুমতি না পেলে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কিছু্ই করার নেই।
ষষ্ঠত: বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেওয়ানী মামলার তুলনায় ফৌজদারী মামলা অধিক থাকে। আর ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলে তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
সপ্তমত: জনগণ অনেক সময় প্রশাসনের বিভিন্ন যন্ত্রনার ফলে হাইকোর্ট বিভাগে রীট করে, কিন্তু অনেক সময় রীটের আওতায় না পড়ায় কিংবা Technical কারণে রীট গ্রহণ করতে পারে না হাইকোর্ট।
উপরোল্লিখিত কারণগুলো থেকে বোঝা যায় যে, নানা কারণে আদালতের বিচারকার্য এবং অধিকার সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বলে ন্যায়পালের প্রয়োজন। কারণ ন্যায়পাল একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বিধায় সঠিকভাবে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়।