সরকারি প্রশাসন বা লোকপ্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনের সম্পর্কের ক্ষেত্র দু’টি বিপরীতমুখী মতবাদ রয়েছে। একটি মতবাদ অনুযায়ী সরকারি প্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসন এক ও অভিন্ন। এবং অন্য মতবাদ অনুযায়ী এই দুই প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
যারা লোকপ্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনকে এক ও অভিন্ন বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে আরউইক (Urwick), হেনরী ফেয়ল (Henri Fayol), মেরী পার্কার ফলেট (Mary Parker Follet) প্রমুখ। পক্ষান্তরে, যারা লোকপ্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে প্রয়াসী হয়েছেন তাদের মধ্যে পল এইচ অ্যাপলেবি (Paul H. Appleby) ও অধ্যাপক সাইমনের (Professor Herbert A. Simon) নাম উল্লেখ করা যায়।
সরকারি প্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনের পার্থক্য সম্পর্কে হারভে শ্যারম্যান (Harvey Sherman) বলেন, “The line between public and private administration is so blurred that it is possible to tell where government leaves off and private business begins.”
উভয় প্রশাসনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও পরিবেশগত কারণে কিছু পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হল-
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগত পার্থক্য
লোকপ্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য হল জনকল্যাণ করা আর বেসরকারি প্রশসানের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তি কল্যাণ বা ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করা। মানুষের মঙ্গলের জন্য যা করার দরকার সরকারি প্রশাসন তাই করতে চেষ্টা করে। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসন ব্যক্তি স্বার্থের উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট থাকে।
২. আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্র
উভয় প্রশাসন আইনমাফিক কাজ করে। কিন্তু সরকারি প্রশাসন যেভাবে আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কাজ করে বেসরকারি প্রশাসন সেভাবে করেনা। যদি আমরা কোন কিছু ক্রয়ের কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে সরকারের বেলায় টেন্ডারের মাধ্যমে অনেক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে ক্রয় করতে হবে। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসন বাজারে গিয়েই পছন্দমত জিনিস ক্রয় করতে পারে।
৩. কর্মপরিসরগত পার্থক্য
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যত বড়ই হোক না কেন সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তার কর্ম পরিসর সীমিত। আগে সরকারের কর্ম পরিসর কিছুটা সীমিত থাকলেও বর্তমানে রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী কার্যাদির বৃদ্ধির ফলে কর্মপরিসর অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
৪. পদমর্যাদা ব্যবহারের ক্ষেত্রে
সরকারি কোন কর্মকর্তা তার পদমর্যাদা ব্যবহার করে সামাজিক কোন সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন না। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলে পদমর্যাদা ব্যবহার করে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন। আমলাতন্ত্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্যই সরকারি পদমর্যাদা ব্যক্তিগত, সামাজিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
৫. জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে
লোক প্রশাসন স্বীয় কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়ী থাকে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে প্রশাসনকে মন্ত্রীর মাধ্যমে আইন পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কাজেই প্রতিটা কাজ করার সময় ভেবে চিন্তে করতে হয়। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসনকে এভাবে জনগণের কাছে বা আইন পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সে অনেকটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
আরও পড়ুন: লোকপ্রশাসন অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা
৬. প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে
অনেক সময় সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু জনকল্যাণের কথা চিন্তা করে সরকার কখনও প্রকল্প বন্ধ করে দেয়না। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন প্রকল্প ক্ষতির সম্মুখীন হলে তা সাথে সাথে বন্ধ করেও দেয়।
৭. নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে
সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তারা কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। সকলের জন্য একই আইন, একই সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। নিরপেক্ষতা আমলাতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বাধ্য নয়। এবং বেশির ভাগ সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখেও না। সামাজিক পদমর্যাদা দেখে তারা সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে।
৮. রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে
লোকপ্রশাসনের কার্যগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আওতাধীন। রাজনৈতিক নির্দেশনা না পেলে অনেক সময় তারা কাজ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু বেসরকারি প্রশসানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নির্দেশনা তাদের কার্যকে প্রভাবিত করে না। এখানে সিদ্ধান্ত আসে মালিকের কাছ থেকে।
৯. মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে
মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো এবং স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান হল লোক প্রশাসন। সাধারণ মানুষ তথা জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে থাকে এই প্রশাসন। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থমূলক কার্যাদি নিয়ে অত চিন্তা করে না। জনগণের সমস্যা সমাধানের তাদের তেমন কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে।
১০. কাজের ধরণের ক্ষেত্রে
বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলো লোক প্রশাসনই পরিচালনা কর। তাছাড়া, জনগুরুত্বপূর্ণ অত্যন্ত জরুরি প্রকৃতির কাজগুলো যেমন- পানি সরবরাহ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরকারি প্রশাসন করে থাকে। জনগুরুত্বপূর্ণ কাজের বেলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে আসে না।
১১. আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে
সরকারি কার্যাবলি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা যায়। অর্থাৎ লাল ফিতার দৌরাত্ম বেশি দেখা যায়। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যাবলি সম্পাদনে আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-নীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখায়।
১২. অর্থসংক্রান্ত ক্ষেত্রে
সরকারি কর্মকর্তারা আইনসভা থেকে অনুমোদন না পেলে অর্থ ব্যয় করতে পারে না। তাছাড়া, সরকার অগে ব্যয় নির্ধারণ করে তারপর আয়ের ব্যবস্থা করে। সরকার ইচ্ছা করলে আয় বাড়াতে পারে। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসন আগে আয় নির্ধারণ করে তারপর ব্যয় করে থাকে। তাদের আয় বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। তাছাড়া, তাদের আয়-ব্যয় আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ নয়।
১৩. সার্বভৌম ক্ষমতার ক্ষেত্রে
লোকপ্রশাসনের কাছেই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে। কিন্তু বেসরকারি প্রশাসনের কাছে এ ধরণের কোন ক্ষমতা থাকে না। যার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে মুখাপেক্ষী হতে হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, সরকারি প্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনের মধ্যে এ সমস্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একেবারে সম্পর্কহীন নয়। উভয়ের পার্থক্য কেবলমাত্র পরিমাণগত বা মাত্রাগত, গুণগত নয়।