ইউরোপের ইতিহাসে ১৮১৫ সালে সংঘটিত ওয়াটার লু যুদ্ধ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সম্মিলিত বাহিনী এবং ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের মধ্যে এ ভাগ্য নির্ধারণকারী ওয়াটার লু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওয়াটার লু যুদ্ধ মহাবীর নেপোলিয়নের জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পতন ঘটে।
ওয়াটার লু যুদ্ধের পটভূমি
১৮১৩ সালে সংঘটিত লিপজিগের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর নেপোলিয়ন ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হন। নেপোলিয়নের সিংহাসন ত্যাগ ও নির্বাসনের পর অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময় মিত্রশক্তিবর্গ ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে ফ্রান্স সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন: কোড নেপোলিয়ন বলতে কি বুঝ?
প্যারিসের প্রথম সন্ধি অনুসারে বেলজিয়াম ও অন্যান্য রাজ্যাংশ ফ্রান্সের হস্তচ্যুত হলে ফরাসি জনগণের মাঝে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। একই সাথে ফ্রান্সে আর্থিক সংকট প্রবল হয়ে উঠে। এ অবস্থায় নেপোলিয়ন এলবা দ্বীপ থেকে পালিয়ে ফ্রান্সের ক্যানে নগরে আগমণ করেন। এবং ১৮১৫ সালে প্যারিস নগরে প্রবেশ করে ফ্রান্সের শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। সম্রাট নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তন মিত্রপক্ষের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। ১৮১৫ সালে ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়া নতুন আক্রমণাত্মক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নেপোলিয়নকে উৎখাতের পদক্ষেপ নিলে ওয়াটার লু যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ওয়াটার লু যুদ্ধ
সম্রাট নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে মিত্রপক্ষের প্রতিনিধিগণ ভিয়েনায় মিলিত হন। তারা নেপোলিয়নকে আইন বহির্ভূত এবং বিশ্বশান্তির অন্যতম শত্রু বলে ঘোষণা করেন। ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়া নতুন এক আক্রমণাত্মক চুক্তি সম্পাদন করে নেপোলিয়নকে তিন দিক থেক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।
ওয়েলিংটনের নেতৃত্বে উত্তর দিক থেকে ব্রিটিশ বাহিনী ও ব্লুবচার এর নেতৃত্বে প্রুশিয়া বাহিনী, আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে পূর্ব দিক থেকে রুশ বাহিনী এবং শোয়ারজেনবার্গ এর নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া বাহিনী ফ্রান্সে একযোগে আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত স্থির করে। এ অবস্থায় নেপোলিয়ন দ্রুতগতিতে বেলজিয়ামের দিকে অগ্রসর হন।
ফরাসি বাহিনী লিঞ্জি (Lingy) ও কোয়ার্টার ব্রাস (Quarter Brass) এই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এ সময় ইংরেজ সেনাপতি ও মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ডিউক অব ওয়েলিংটন ফরাসি আক্রমণ মোকাবিলার জন্য বেলজিয়ামের ওয়াটার লু প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ করেন। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটার লু প্রান্তরে প্রচণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হয়।
প্রথম দিকে নেপোলিয়ন সাফল্যের পরিচয় দিলেও প্রুশিয়ার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ব্লুচার সসৈন্য ডিউক অব ওয়েলিংটনের সাথে যোগ দিলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এবং সম্মিলিত বাহিনীর নিকট নেপোলিয়ন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
ওয়াটার লু যুদ্ধের ফলাফল
ওয়াটার লু যুদ্ধের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনীর ৩৭ হাজার সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে, ব্রিটেনের ১৩ হাজার ও রাশিয়ার ৬ হাজার সৈন্য এ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। ওয়াটার লু যুদ্ধ মহাবীর নেপোলিয়নের জীবনের শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তার চূড়ান্ত পতন ঘটে। ইংরেজ সরকার তাকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করে এবং নজরবন্দি করে রাখে। নির্বাসিত অবস্থায় ১৮২১ সালে নেপোলিয়ন মৃত্যুবরণ করেন।