১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ বিপ্লব শুধু ইউরোপে নয়, বরং বিশ্ব ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। এ বিপ্লবের প্রভাবে ফ্রান্সের পুরাতন সমাজ কাঠামোর ভিত ধসে যায়। ফলে চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়। এ বিপ্লবের মৌলিক আদর্শ ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী।
ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লব হল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এবং অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অধিকার বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের এক সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস। শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচারের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দীর্ঘকাল ধরে ফরাসি বিপ্লবের পিছনে ইন্ধন যুগিয়ে আসছিল। ১৯৮৯ সালে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, সামাজিক বৈষম্যের শিকারে পদদলিত এবং অর্থনৈতিক শোষণে নিঃস্ব ও রিক্ত জনগণের কঠোর প্রতিবাদ বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করে। বিপর্যয়কর রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নৈরাশ্যজনক সামাজিক অবস্থা, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতি এবং আরো বহুবিধ কারণের সহযোগে এ বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অবশেষে বিপ্লবীরা ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে এর পতন ঘটায়। এ বাস্তিল দুর্গ পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।
১৭৮৯ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত এ বিপ্লবের গতিধারা ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপকে আন্দোলিত করে। এ বিপ্লবের মৌলিক আদর্শ স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী পুরো বিশ্ব রাজনীতিতে নব মূল্যায়নের সূচনা করে। তাই ফরাসি বিপ্লবকে কালজয়ী মহান বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ফরাসি বিপ্লবের কারণসমূহ
ফরাসি বিপ্লবের পিছনে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণসমূহ তুলে ধরা হল-
১। ঈশ্বর প্রদত্ত রাজশক্তিতে বিশ্বাসী রাজতন্ত্র
রাজা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার উপর নিজের স্বৈরাচারী শাসন নির্ভরশীল মনে করতেন। জনমতের কোন স্থান সেখানে ছিল না।
২। সামরিক মর্যাদা ও প্রাধান্য হ্রাস
আঠারো শতকের প্রারম্ভে স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় এবং ইউটেক্ট সন্ধি দ্বারা সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিতে ও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ফরাসি সামরিক মর্যাদা লোপ পায়।
৩। দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন
ফরাসি রাজতন্ত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ছিল প্রশাসনে এক শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থবাদী আমলার স্বৈরাচারী কার্যকলাপ। অকর্মণ্য রাজা পঞ্চদশ লুই এসব আমলাকে নিবৃত্ত করতে পারেন নি। এদরে প্ররোচনায় তিনি প্রজাহিতৈষী মন্ত্রী ও আমলাদের পদচ্যুত করতেন।
৪। ত্রুটিপূর্ণ রাজস্ব ব্যবস্থা
ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় বিপুল সম্পত্তি নিষ্কর হিসেবে ভোগ করতো। পক্ষান্তরে তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের বহুবিধ কর প্রদান করা ছাড়াও বিভিন্ন রাজকার্যে বেগার খাটতে হতো।
৫। রাজকোষে আর্থিক সংকট
চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে চারটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ফরাসি রাজকোষকে শূন্য করে ফেলেছিল। পঞ্চদশ লুই অর্থনৈতিক সংকটের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও অভিজাতদের বিরোধিতার মুখে তা সম্ভব হয় নি। কারণ এতে দেশের সকল সম্পত্তির উপর কর আরোপের ব্যবস্থা ছিল। ফলে বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনীতি সবদিক থেকে পঙ্গু হয়ে পড়ে।
৬। রাজতন্ত্রের সংকট
সতেরো শতকের ফ্রান্স ছিল চতুর্দশ লুইয়ের গঠিত এক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। সমসাময়িক কালে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্স ছিল আয়তন, জনসংখ্যা বিত্ত, সামরিক শক্তি সর্বদিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আঠারো শতকে ফ্রান্স ছিল অকর্মণ্য রাজা পঞ্চদশ লুই, রাজপ্রতিনিধি ডিউক অব অর্লিয়েন্স ও দুর্বলচেতা রাজা ষোড়শ লুইয়ের দ্বারা শাসিত এক পতনোন্মুখ রাষ্ট্র।
আরও পড়ুন: ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ : কি ছিল ফলাফল?
ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল
ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি সমগ্র ইউরোপকে এক প্রচণ্ডরকম নাড়া দিয়েছিল। নিম্নে ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করা হল-
১। নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি
বিপ্লবোত্তরকালে ফরাসি সমাজে মানুষ নিজের প্রয়োজনোপযোগী নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে নতুন নতুন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
২। জাতীয়তাবাদী ধারণার বিকাশ
ফরাসি বিপ্লবের ফলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
৩। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভব
ফরাসি বিপ্লবের ফলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
৪। গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি
বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীরা রুশোর গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান দেয়। গণতন্ত্রের পরিধিকে বৃদ্ধি করতে তারা ব্যাপক ভোটাধিকার দাবি করে।
৫। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সূচনা
ফরাসি বিপ্লবোত্তর যুগে গির্জার প্রভাব ক্ষুণ্ণ কর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সূচনা হয়।
৬। বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন
অতীতে রাজার আদেশ বা ইচ্ছায় আইনের মর্যাদা পেলেও বিপ্লবের পর বিচারকদের পদ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। দরিদ্র ও সাধারণ নাগরিকরা যাতে সুবিচার পায় তার ব্যবস্থা করা হয়।
৭। প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিকাশ
ব্যক্তির প্রকৃত মর্যাদার মূল্যায়ন হওয়ায় মানুষ সর্বক্ষেত্রে প্রগতিশীল হয়ে উঠে।
৮। সামন্ততন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের পতন
ফরাসি বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীরা বুর্জোয়া গোষ্ঠী, সামন্ত ও অভিজাতদের সকল ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য ভেঙে চুরমার করে দেয়।
৯। পুঁজিবাদের উত্তরণ
বিপ্লবের পর পুঁজিবাদের দ্রুত প্রসার ঘটে। এই সুযোগে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর অর্থ সঞ্চয় করে বুর্জোয়া স্তরে উঠে যায় এবং নতুন পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।
১০। রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা
বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক ভোটাধিকার, সভা-সমিতি এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
১১। উগ্র জাতীয়তাবাদ
বিপ্লবের ফলে যে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় তা ক্রমে উগ্র জাতীয়তাবাদের রূপ ধারণ করে। ফলে ইউরোপে জাতিগত দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নেপোলিয়ন উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই মহাদেশীয় ব্যবস্থা জারি করেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদের ফসল।
১২। বিপ্লবী ভাবধারার উন্মেষ
ফরাসি বিপ্লবীরাই ইউরোপের সর্বত্র বিপ্লবের অমোঘ বাণী স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করে বিপ্লবী ভাবধারার উন্মেষ ঘটায়।