বাংলা বানান সংস্কারের প্রেক্ষাপট
বাংলা বানান এর বিশৃঙ্খলার শুরু অনেক আগে থেকেই। প্রাচীন ও মধ্য যুগে পুঁথিতে বাংলা ভাষা লিপিবদ্ধ হওয়ার সময়ে স্বভাবতই তখন সর্বজন সম্মত কোনো মানরূপ ছিল না। ফলে শব্দের বানান ভিন্নতা তখন থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করে। ছাপাখানার মাধ্যমে বাংলা ভাষা মুদ্রণ ও প্রকাশনার যুগে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলার মূলে ছিল লিপিকারদের ইচ্ছাকৃত বানান ব্যবহার। তবে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে আধুনিক বাংলা গদ্য ভাষা ও সাহিত্য গড়ে উঠার কালে লেখায় ও মুদ্রণে বাংলা ভাষার একটি মানরূপ দেওয়ার চেষ্টা চলে।
তখন তৎসম শব্দের বানানের বিশৃঙ্খলা দূর করে মোটামুটি একটি প্রমিত রূপ গড়া সম্ভব হলেও অতৎসম শব্দের বানানে বিশৃংখলা থেকেই যায়। আর সে কারণে, বিশ শতকের শুরুতে বাংলা ভাষার অভিধান রচনা করতে গিয়ে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিধান সংকলক জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস বাংলা বানানের বিশৃংখলার মুখোমুখি হন এবং তাঁর “বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (১৯১৭)” – এর ভূমিকায় বাংলা বানানের সমস্যার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯২৬ সাল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত “The Origin Development of the Bangali Language” গ্রন্থে উক্ত সমস্যার স্বরূপ অনেকাংশে তুলে ধরেন। বাংলার আরেক জন শ্রেষ্ঠ অভিধানকার হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর “বঙ্গীয় শব্দকোষ (১৯৩২)”-এর ভূমিকাতে বাংলা বানানের সমস্যা নিয়ে হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, “বাঙালায় শব্দের বানান এক বিষম সমস্যা, এখনই ইহার সমাধান হয় নাই, হইবে কিনা জানি না।”
আরও পড়ুন: হোসেন শাহী আমলকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন?
বাংলা বানানের সমতা বিধানে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা বা উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারই অনুরোধে বাংলা বানানের বিশৃংখলা দূর করা, বাংলা বানান সংস্কার ও বানানরীতি মোটামোটি নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার বাহন হিসেবে ঘোষণা করে রাজশেখর বাসুকে সভাপতি এবং চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সম্পাদক করে বানানের নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সমিতি গঠন করেন। সমিতি এ সম্পর্কে যে সুপারিশ প্রণয়ন করেন তা “বাংলা বানানের নিয়ম” নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালের ৮ই মে।
কিছু রক্ষণশীল পন্ডিত বানান কাঠামোর বিরোধীতা বা ভিন্নমত ব্যক্ত করলেও রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র ওই সুপারিশ অনুযায়ী বানান লিখতে সম্মত হলে বিশ্ববিদ্যালয় ওই নিয়ম চালু করার পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন। তবে বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত কিছু মতামত ও ভিন্নমত বিবেচনায় নিয়ে সামান্য পরিবর্তন করে ১৯৩৭ সালের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় “বাংলা বানানের নিয়ম” এর তৃতীয় সংস্করণ করেন।
সকলে সর্বোতভাবে তা মেনে না নিলেও পরবর্তীকালে, ওই বানান বিধিই সর্বাধিক মান্য বলে বিবেচিত হয়।
শেখর বসুর “চলন্তিকা, (১৯৩০)” কাজী আবদুল ওদুদের “ব্যবহারিক শব্দকোষ, (১৯৪৩)” সহ সব অভিধানে ১৯৩৭ সালের ওই বানান বিধি গৃহীত হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলা বানান লিপির সংশোধন চেষ্টা করেন। তবে এটা সফল হয় নি।
১৯৪৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বানান সমতার নীতিমালা প্রণয়ন করেন
১৯৮৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বাংলা বানান নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেন।
১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়ন করে বাংলা একাডেমি তার প্রকাশিত পুস্তকে এই বানান রীতিই ব্যবহার করে।
যবনিকায়, আলোচনার উত্তাল বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে বলবো যে, বাংলা বানানের নীতিমালার ক্ষেত্রে প্রাণান্তর প্রচেষ্টা চললেও বাংলা বানানের সমস্যা এখনো আমাদের একটি বিরাট সমস্যা।