শশাঙ্ক
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক একটি বিখ্যাত নাম। শশাঙ্ক শুধু গৌড়ের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন নি, বরং গৌড় রাজ্যের সীমানা মগধ ও উড়িষ্যার উত্তরাঞ্চলে বৃদ্ধি করেছিলেন। এমন কি উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার শক্তি ও তিনি অর্জন করেন। শশাঙ্কই একমাত্র শাসক যার সময়ে বাংলার সীমানা বঙ্গ দেশের বাইরে বিস্তার লাভ করেছেন। তিনি সামান্য একজন সামন্ত থেকে স্বীয় যোগ্যতায় ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তাকে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে প্রথম প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ নরপতি বললেও ভূল হবে না।
উৎস
বাংলার স্বাধীন নরপতি শশাঙ্ক সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের যেসব উৎসের উপর নির্ভর করতে হয় তা নিম্নরূপ-
- প্রাচীন রোহিতাশ্বরে (রোটাসগড়) গিরিখাতে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচ।
- বাণভট্ট রচিত “হর্ষচরিত” গ্রন্থ।
- চৈনিক পরিব্রাজক “হিউয়েন সাং” এর বিবরণী।
- বৌদ্ধগ্রন্থ “আর্য-মঞ্জুশ্রী মূলকল্প”।
- হর্ষবর্ধনের “বাঁশখেরা ও মধুবন” তাম্রশাসন।
এছাড়া সঞ্জাম ও ছুরিতে তাম্রশাসন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বংশ পরিচয়
শশাঙ্কের পরিচয় ও জীবনী সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ থাকায় এ বিষয়টি আজও আমাদের নিকট তেমন সুস্পষ্ট নয়। তার আমলের ইতিহাসের যে সকল উপাদান পাওয়া গেছে তাতে বেশীর ভাগ বিপরীতমুখী বর্ণনার সমাবেশ ঘটেছে। শশাঙ্কের অপর নাম নরেন্দ্রগুপ্ত এবং তিনি গুপ্ত রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই মতটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে মনে হয়। প্রাচীন রোহিতাশ্বরে (রোটাসগড়) গিরিখাত্রে একটি সিলের ছাঁচ পাওয়া গেছে। তাতে “শ্রী মাহসামন্ত শশাঙ্ক” নামটি খোদিত আছে। যদি এই শশাঙ্ক ও গৌড়রাজ শশাঙ্ককে অভিন্ন বলে গ্রহণ করা যায় তা হলে স্বীকার করতে হবে যে, শশাঙ্ক প্রথমে একজন মহাসান্ত ছিলেন। কেউ কেউ অনুমান করেন, শশাঙ্ক মৌখরী রাজ্যের সামন্ত রাজা ছিলেন। কিন্তু পূর্বে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত মগধ ও গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। সুতরাং বলা যায়, শশাঙ্ক এই মহাসেন গুপ্তের অধীনে মহাসামন্ত ছিলেন।
সিংহাসনারোহণ
শশাঙ্কের ক্ষমতালাভ ও সিংহাসনারোহণ সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে এ কথা স্পষ্ট যে, সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন এক সময়ে গৌড় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হন। ধারণা করা হয় যে, তিনি গুপ্তরাজ মহাসেন গুপ্তের মহাসামন্ত ছিলেন। এবং পরবর্তী সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ থেকেই তিনি স্বাধীন গৌড় রাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন।
শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরামপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
রাজ্যসীমা ও রাজ্যবিস্তার
শশাঙ্কের রাজত্বের প্রথম থেকেই মগধ (দক্ষিণ বিহার) অঞ্চল তার অধিকারে ছিল। শশাঙ্ক প্রথম থেকেই তার রাজ্যসীমা বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল তার সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল কি না সে সম্পর্কে সঠিক জানা যায় না। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে তিনি প্রথমেই রাজ্যসীমা বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যে তার রাজ্য দক্ষিণ উড়িষ্যার চিল্কা হৃদ পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ৬১৯ খৃঃ গঞ্জম তাম্রশাসনে। এ তাম্রশাসনে আরও জানা যায় যে, কঙ্গোজের শাসনকর্তা মহারাজ মহাসামন্ত শ্রী মাধবরাজ শশাঙ্ককে অধিরাজরূপে স্বীকার করেছিলেন।
শশাঙ্ক ভাস্কর বর্মাকে পরাজিত করে কামরুপ জয় করেন। এছাড়া বারাণসি, মেদিনীপুর তার সাম্রাজ্যভূক্ত করেন। শশাঙ্ক আমৃত্যু তরা রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রাখেন।
আরও পড়ুন: মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা পর্যালোচনা কর
মৌখরীদের সঙ্গে সংঘর্ষ
উত্তর ভারতের রাজনীতিতে শশাঙ্কের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ সম্বন্ধে বাণভট্টের হর্ষচরিত এবং তার সমসাময়িক চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণী থেকে জানা যায়। শশাঙ্ক কর্তৃক উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার প্রধান উদ্দেশ্য মৌখরীদের বিরুদ্ধে স্বরাজ্যকে দৃঢ়ভাবে সংরক্ষণ। কারণ পূর্ব থেকেই গৌড়ের পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজাদের সঙ্গে মৌখরী রাজাদের বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। তাই শশাঙ্ক ক্ষমতা লাভের পর গৌড় কনৌজের শত্রুতার জের চলতে থাকে।
মালব রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব
সমসাময়িক কালে কনৌজের মৌখরি রাজ গৃহবর্মন পুষ্যভূতি রাজা প্রভাকর বর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিয়ে করেছিলেন। শশাঙ্ক বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই বন্ধুত্ব মৌখরি রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিনিও কুটনৈতিক সুত্রে মালব রাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এবং স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করেন।
দেবগুপ্তের দ্বারা গৃহবর্মনকে আক্রমণ
থানেশ্বর রাজ প্রভাকর বর্ধনের অসুস্থতার সুযোগে মালব রাজা দেবগুপ্ত মৌখরি রাজ গৃহবর্মনকে আক্রমণ করেন। এবং তার স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে কনৌজে বন্ধি করেন। দেবগুপ্ত নিজ সাফল্যে উল্লাসিত হয়ে মিত্রশক্তি শশাঙ্কের আগমনের অপেক্ষা না করেই থানেশ্বর রাজ আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এই সংবাদ পেয়ে থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন ভগ্নি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য স্বসৈন্যে কনৌজের দিকে যাত্রা করেন।
এরপর ২য় পর্বে রাজ্যবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সংঘর্ষ বর্ণনা করা হয়েছে।