আমলাতন্ত্র বলতে আক্ষরিক অর্থে আমলা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাসন বুঝায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমলাতন্ত্র বলতে স্থায়ী, বেতনভুক্ত, দক্ষ ও পেশাদার কর্মচারীদের সংগঠনকে বুঝায়। এসব কর্মচারী কোন সংগঠনের জটিল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুশৃংখলভাবে পরস্পর সংযুক্ত থেক কাজ করে।
আমলাতন্ত্র কি ?
আমলাতন্ত্র হচ্ছে উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ পরিচালিত শাসনব্যবস্থা, যারা অরাজনৈতিক প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়নের সাথে জড়িত। নিচে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলো-
অধ্যাপক ফিফনার এবং প্রেসথাস – এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের কর্মকান্ডকে এমন এক পদ্ধতিতে সংগঠিত করা যা সুসংহতভাবে গোষ্ঠী শ্রমের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়।”
এফ. এন. মার্কস – এর মতে, “আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটি বিশেষ ধরণের সংগঠন এবং সরকারি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ পদ্ধতি।”
অধ্যাপক গার্নার বলেন, “এককথায় সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা নির্ধারণে এবং সাধারণভাবে সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মচারীগণই আমলা নামে পরিচিত।”
আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
১) পদসোপান নীতি
আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পদসোপান নীতি অনুসরণ। পদসোপান নীতি হলো এমন একটি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা যার মাধ্যমে উর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মচারীদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মাধ্যমে পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত করা হয়। পদসোপান ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তির উপর একজন উপরস্থ কর্মকর্তা থাকেন। প্রশাসনিক কাঠামোর পদগুলো মর্যাদা ও কর্তৃত্বের অনুসারে স্তরবিন্যাস করা হয়। সংগঠনের শীর্ষতম কর্মকর্তাই প্রধানত সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করেন।
২) বিশেষীকরণ
আমলাতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষীকরণ। প্রযুক্তি বিদ্যার নৈপুণ্য অর্জনের প্রয়োজনেই আমলাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে। আমলাগণ কোন কাজে বিশেষভাবে নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং বার বার একই কাজ করে পরিপূর্ণরুপে কাজকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসেন। কোন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ভিত্তি কোন নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ ধরণের প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা বিবেচিত হওয়ায় বিশেষায়নের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩) আইনের সুকঠোর অনুশাসন
আমলাদের আচরণ আইনের সুকঠোর অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আইনের অনুমোদন ব্যতীত আমলাগণ প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করতে পারেন না। আইনের অনুশাসন বলতে বুঝায় যেসব প্রশাসনিক কাজের জন্য নাগরিক অধিকার বিপন্ন হয়, সেসব কাজের পিছনে আইনের অনুমোদন থাকতে হবে। আইনসঙ্গত না হলে প্রশাসকগণ ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। প্রশাসক আমলাদের কাজকর্ম সংসদীয় আইনের অধীনে প্রশাসনিক আইন ও নিয়মকানুন দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠার ফলে প্রতিটি কাজের একটি নির্ধারিত মান নির্ণয় করা যায়। প্রশাসকদের স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা আইন সাপেক্ষ ও যুক্তি ও ন্যায়সংগত হতে হবে। আইন কাঠামো ভিত্তির জন্যই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলারা অত্যন্ত নমনীয় মনোভাবের পরিচয় দেন।
৪) যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ
শিক্ষা ও পেশাগত যোগ্যতা অনুসারে কর্মচারী নিয়োগ আমলাতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে প্রতিটি পদের কার্যপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সেই মোতাবেক পদে নিয়োগের উদ্দেশ্যে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় এবং উপযুক্ত যোগ্যতা অনুসারেই কর্মচারীদের নিয়োগ দান করা হয়। নিয়োগদানের পর কর্মচারীবৃন্দকে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
৫) নির্ধারিত বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
যোগ্যতা ও পদমর্যাদ অনুসারে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। আমলাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন একটি বেতনক্রমের অন্তর্ভূক্ত। বেতনের সাথে নানারকম ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও জড়িত। সরকারি সংগঠনে এ বেতনক্রম সংগঠনের সফলতা বা কার্য সম্পাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।
৬) স্থায়িত্ব
আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর স্থায়িত্ব। এ সংগঠন একটি দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব ভোগ করে। সরকারি সংস্থাসমূহের কার্যাবলিকে জনকল্যাণমূলক বলে ধরা হয় এবং এ কারণে এ সংস্থাগুলো জনস্বার্থের খাতিরে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব বহন করে।
৭) লিখিত আদেশ, নির্দেশ ও দলিল
আমলাতন্ত্রে প্রণীত সকল প্রকার প্রশাসনিক আইন, সিদ্ধান্ত ও নিয়মকানুনকে লিপিবদ্ধ করা হয়। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে সর্বত্রই লিখিত আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। লিখিত আইন প্রশাসনকে জনগণের কাছে জবাবদিহিবদ্ধ করে তোলে এবং ভবিষ্যৎ কার্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিক নির্দেশিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
৮) নৈর্ব্যক্তিক আদেশ
নৈর্ব্যক্তিক আদেশ বলে একজন উর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার অধীনস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে আদেশ দিয়ে থাকেন এবং তার আনুগত্য লাভ করেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধস্তনকে এরুপ আদেশ প্রদান করতে পারেন। পদাধিকারের ভিত্তিতে তিনি অধস্তনকে নৈর্ব্যক্তিক আদেশ প্রদানের ক্ষমতা লাভ করেন।
৯) নিরবচ্ছিন্নতা
আধুনিক গণতন্ত্রে দলীয় শাসন থাকায় ঘন ঘন সরকারের পরিবর্তন হয়। সরকারের এরুপ উত্থান পতনের মধ্যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীগণই প্রশাসনের কার্যে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন। অর্থাৎ দলীয় সরকারের প্রায়ই পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু আমলারা টিকে থাকে।
১০) পরিবর্তনশীলতা
পরিবর্তনশীলতা আমলাতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। রাষ্টনীতির উর্ধ্বে থেকে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ ও লক্ষ্য অনুসারে দলীয় কার্যক্রমকে বাস্তবে রুপায়িত করার ব্যাপারে আমলাদের সার্বভৌম চেষ্টা করতে হয়। তাই তাদের পরিবর্তনশীল মানসিকতার অধিকার হতে হয়।
১১) নিরপেক্ষতা
আমলাতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষভাবে প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন করা। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু রাজনীতি উর্ধ্বে রেখে সরকারি নীতিসমূহকে বাস্তবে রূপায়িত করা আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
১২) অজ্ঞাতনামা থাকা
অধিকাংশ আমলাদের অজ্ঞাতনামা থেকে প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে রাজনৈতিক প্রশাসকদের নামে তাদের কার্য সম্পাদন করতে হয়। তাই প্রশাসনিক কার্যের সুনাম বা দুর্নামের অংশীদার তাদের হতে হয় না।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণের কারণ ও প্রভাব
আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি
১) সরকারি নীতি নির্ধারণ
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার এবং সরকারের নিকট মানুষের দাবি-দাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশাসনিক পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ও দক্ষতার সাথে সরকারের নীতি নির্ধারণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
২) সরকারি নীতি বাস্তবায়ন
আমলাতন্ত্র সরকারি নীতি নির্ধারণ করার কাজে নিয়োজিত থাকে। আর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এ সকল নীতিসমূহকে বাস্তবায়িত করাও আমলাদের অন্যতম প্রধান কাজ। তবে সরকারি নীতি কতটুকু কার্যকরী করা হবে, তা নির্ভর করে আমলাদের দক্ষতা, দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক ইচ্ছার উপর।
৩) আইন প্রণয়ন করা
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক বিভাগই অধিকাংশ আইনের সূচনা করে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিল আইনসভায় উপস্থাপিত হয়ে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই প্রশাসনিক বিভাগ ও সংস্থায় সর্বপ্রথম গৃহীত হয়।
৪) আইন বাস্তবায়ন করা
আমলাতন্ত্র কেবল আইন প্রণয়নে সাহায্য করে না, আইন কার্যকর করাও এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বস্তুত আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের প্রভাব অত্যধিক। আমলাগণ কোন আইনকে বাতিল কিংবা তাদের বিশেষ ক্ষমতা আরোপ করে কার্যকর করে থাকে।
৫) পেশাগত ও নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা
আমলাতন্ত্র পেশাগত ও নৈতিক মূল্যবোধের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। একজন সরকারি কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত কেবল তার ব্যক্তিগত নীতিবোধ ও মূল্যবোধের মাধ্যমে প্রভাবিত হয় না, বরং তা পেশাগত মূল্যবোধ দ্বারাও অনেকাংশে প্রভাবিত হয়ে থাকে। আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের মাধ্যমেই এ উভয় প্রকার মূল্যবোধের ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
৬) জনস্বার্থ সম্পর্কিত কার্যাবলি পরিচালনা করা
আমলাতন্ত্র সরকারের জনস্বার্থ সম্পর্কিত কার্যাবলি পরিচালনা করে। এসব কাজের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনহিতকর কার্যাবলি, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সংস্থাপন বিভাগ, রাজস্ব ব্যবস্থা প্রভৃতি অন্তর্ভূক্ত।
৭) দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন
শাসন বিভাগের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করে আমলাতন্ত্র। এর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনা। আমলারা বিভিন্ন স্তরে এ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।
৮) সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের কাজ
প্রত্যেক রাজিনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র সংবাদ ও তথ্যাদি আদান-প্রদানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোকে তথ্য ও সংবাদ আমলারাই সরবরাহ করে থাকেন। জনসাধারণ রাজনৈতিক দল এবেং স্বার্থগোষ্ঠীসমূহও আমলাগোষ্ঠী পরিবেশিত এই তথ্যাদি ও সংবাদের উপর নির্ভরশীল।
৯) বিচার সংক্রান্ত কাজ
সাম্প্রতিককালে প্রায় সবদেশেই বহু বিবাদের বিচার সাধারণ আদালতে হয় না, হয় প্রশাসনিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে। প্রশাসনের সাথে সংযুক্ত কর্মচারীদের বিচারের জন্য প্রশাসনিক বা বিভাগীয় আদালত দেখা যায়। এসব আদালত মুখ্যত পরিচালিত হয় উচ্চপদস্থ আমলাদের দ্বারা।
১০) পররাষ্ট্র নীতির রূপায়ন
সাম্প্রতিককালে পররাষ্ট্র নীতির গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রেই পররাষ্ট্র দপ্তর শাসন বিভাগের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সকল দেশেই পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা নির্মাণ করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। কিন্তু বৈদেশিক সম্পর্কের খুুঁটিনাটি ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি বাস্তবায়নে দায়িত্ব অর্পিত থাকে আমলাদের উপর। আন্তর্জাতিক আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে আমলারাই অধিকাংশ সময় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১১) প্রশাসনে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার নিয়ত পরিবর্তনশীল। নানা কারণে সরকার যেকোন সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে বা হচ্ছেও। সরকারের এ পরিবর্তনের মধ্যে প্রশাসনে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন সরকারি কর্মচারীগণ।
১২) অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়া একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাজের বাস্তবায়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনমিয় চুক্তি ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে আমলাতন্ত্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। টাকশাল নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মসূচীতে আমলাতন্ত্রের অবদান থাকে।
১৩) অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা
আমলাতন্ত্র শৃঙ্খলা বিধানের অন্যতম সংগঠন। আর একটি সংগঠন হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা বিধানে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৪) সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন
গণতান্ত্রিক দেশসমূহে আমলাগণ সরকারি কর্মকান্ড সম্পর্কে জনগণকে অভিহিত করে থাকেন। জনগণও প্রয়োজনমত আমলাদেরকে তাদের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করে এবং সেসব সমস্যার সমাধান পেতে চায়। এভাবে আমলারা সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন করে।
১৫) অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত কাজ
আমলাগণ অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও পরিচালনা সংক্রান্ত কাজ করে থাকেন। এজন্য আমলাগণকে শাসন বিভাগের সাথে সরকারের অন্যান্য বিভাগের সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হয়।
১৬) যোগাযোগ স্থাপন
আমলাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মকর্তার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা। এ অবস্থায় আমলাগণ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে এবং অধস্তন কর্মচারীদের দপ্তরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে।
১৭) সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ভূমিকা
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইনসভাতে মন্ত্রীদেরকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আমলাগণ মন্ত্রীদেরকে ঐসব প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮) আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত করে
বর্তমানে আমলাতন্ত্রকে আধুনিকতার ধারক বলা হয়। কারণ আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে গতানুগতিক অবস্থা থেকে আধুনিকতার দিকে ধাবিত করছে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র এখন উন্নততর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।
১৯) মন্ত্রীদের সহায়তা
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মন্ত্রীগণ সাধারণত প্রশাসনিক ব্যাপার দক্ষ হন না। কিন্তু সংসদে তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমলারাই মন্ত্রীদের প্রশ্নের জবাব তৈরি করেন এবং মন্ত্রীদের পরামর্শ দান করেন।
২০) রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ রাজনৈতিক উন্নয়নৈর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমলাতন্ত্র দেশের জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে তাদেরকে জাতি গঠন ও নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।
২১) সিদ্ধান্ত গ্রহণ
আমলাগণ দেশের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে যে তথ্য সরবরাহ করেন তার ভিত্তিতেই রাজনৈতিক এলিটগণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একইভাবে রাজনৈতিক দল, স্বার্থবাদী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও জনসাধারণকে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমলাগণ কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
২২) সংস্কারের বাহক
আমালাদের অনেক সময় উন্নয়নের প্রবর্তক বলা হয়। কারণ তারাই দেশে কোন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে এবং সংস্কারক কমিটি গঠণ করে একটি গতিশীল বিষয়ে বাস্তবরুপ দান করতে পারে।
আরও পড়ুন: সরকারি নীতি কি? সরকারি নীতি প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকা।
আমলাতন্ত্রের ত্রুটিসমূহ
আমলাতন্ত্রের ত্রুটিসমূহ নিম্নরূপ-
১) ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কাজ করার অভ্যাস
আমলাতন্ত্রের একটি বড় ত্রুটি হলো সব কিছু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করার অভ্যাস। এমনকি তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারগুলোও সরকারি কায়দায় লেখা হবে, তারপর নির্ধারিত নিয়মে সেগুলো বাদবাকি প্রক্রিয় অনুযায়ী কাজ চালানো হবে। ব্যাপারটি যত জরুরিই হোক, ব্যাপারটিকে সমস্ত সিঁড়িপত্র স্তর পর্যায়ে ঘুরতে হবে। অনেক সময় ফাইল মাসের পর মাস অফিসে চাপা পড়ে থাকে যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরুপ।
২) দায়িত্বহীনতা
যেহেতু আমলারা স্থায়ী কর্মচারী, সেহেতু তারা তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়ী থাকে না। বিভাগীয় মন্ত্রীরা দায়ী থাকেন। আমলাদের কাজকর্মের দায়িত্বশীলতাও মন্ত্রীদের উপর বর্তায়। আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা জনগণের পক্ষে অসম্ভব বলেই তারা জনগণের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দায়িত্বহীন কাজ করে থাকেন।
৩) বিশেষীকরণের দোষ
একজন বিশেষজ্ঞ তার কর্মক্ষেত্রে একটি পেশাগত উগ্র মনোভাব পোষণ করেন। তিনি মনে করেন যে, তিনিই তার কর্মক্ষেত্রে সর্বেসর্বা। এখানে পরামর্শ দেয়ার মতো কেউ নেই। কাজেই তিনি তার কার্যক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেন এবং আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কর্তৃত্ব কাঠামো থেকে নিজেকে সর্বদা দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা দেখান।
৪) ক্ষমতালিপ্সা
আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ক্ষমতালিপ্সা। একদিকে তারা আইনসভার ক্ষমতা কুক্ষীগত করে, অন্যদিকে বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আমলাতন্ত্র জনগণের কল্যাণে যতটুকু সফল হয়েছে, তার চেয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণে অধিক সফল হয়েছে।
৫) বিভাজন
আমলাতন্ত্র সরকারের কাজকর্ম বিভাজিত করে কতিপয় পৃথক ও স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি করে। বিভাগগুলো একে অপরের কর্মপরিধি ও প্রয়োজনের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে কেবল স্থায়ী অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য চেষ্টা চালায়। অবশিষ্ট বিভাগগুলোর সাথে অন্য বিভাগের কোন যোগাযোগ থাকে না। ফলে শাখাগুলো নিজেদেরকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইউনিট হিসেবে পরিচালনা করতে গিয়ে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়।
৬) স্বতন্ত্র শ্রেণী
আমলাতন্ত্র নিজেদেরকে আলাদা শ্রেণী হিসেবে বিবেচনা করে। সরকারি কর্মচারিরা সর্বদাই নিজেদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারা নিজেদের সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ ও যোগ্য দাবি করে এবং মনে করে যে তাদের মর্যাদা সমাজের অন্যান্যদের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।
৭) লালফিতার দৌরাত্ম্য
লালফিতার দৌরাত্ম্য অর্থ পূর্ব নজিরকে অন্ধভাবে অনুসরণ ও মেনে চলা। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় পূর্ব নজিরের সাহায্য নেয়া হয়। ফলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে একই বিষয় বিভিন্ন দফতরে বিভাগীয় প্রক্রিয়ার প্রতীক্ষায় বন্দী থাকে।
৮) আনুষ্ঠানিক বাড়াবাড়ি
আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন বিষয়কে চূড়ান্তভাবে কার্যকর করতে হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে সুসম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ, কর্মপদ্ধতি ও পূর্ব নজিরের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের কর্মকর্তাগণ কর্মদ্যোম, নেতৃত্বের শক্তি ও বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
৯) অবিবেকসুলভ কার্যকলাপ
আমলাতন্ত্রের কর্মচারীরা হয়ত দক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছে, কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে যথাযথ সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত আমলাতন্ত্রে এখন এমন সব প্রবণতা সংযোগ হয়ে গিয়েছে যার ফলে জনমতকে অবজ্ঞার চোখে দেখা এর একটি নীতি হয়ে গেছে।