উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন এর সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্যদিকে, এ সুদীর্ঘ সময়ে ভারতীয় জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রায় এক শত নব্বই বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে। ব্রিটিশ শাসনের পেছনে নিহিত ঘটনাবলি সংক্ষিপ্তভাবে। তুলে ধরা হলো-
ক. ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা-গামা ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করলে ইউরোপ মহাদেশ থেকে ব্যবসায় বাণিজ্য করার জন্য একে একে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসিরা ভারতবর্ষে আসে। সর্বশেষ আসে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক ইংরেজ বণিক সংঘ। ১৬০০ সালে ২১৭ জন অংশীদার নিয়ে এটি গঠিত হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ঐ বছরই ব্রিটেনের রাণী প্রথম এলিজাবেথের কাছ থেকে ভারতবর্ষে ব্যবসায় বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ করে এবং ভারতবর্ষে আগমন করে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতবর্ষে ব্যবসায় বাণিজ্য করার অনুমতি দিলে ১৬১৩ সালে কোম্পানি প্রথম ভারতের সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এরপর একে একে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে কুঠি স্থাপন করে অবাধে ব্যবসায় বাণিজ্য শুরু করে।
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা কর |
খ. পলাশীর যুদ্ধ ও বাংলায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা
ভারতবর্ষে ব্যবসায় বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন ঘটলেও ব্যবসায়ের নামে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে ইংরেজদের সাথে ওলন্দাজ, ফরাসি ও মুঘলদের ছোট ছোট ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হয়। এসব দ্বন্দ্ব মোকাবিলার জন্য অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে দুর্গ গড়ে তুলতে শুরু করে।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের অল্পকাল পরেই ইংরেজদের সাথে নবাবের চরম বিরোধ দেখা দেয়। এ সুযোগে নবাবের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। শুরু হয় নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মুর্শিদাবাদের কাছে পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় ঘটে। অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য। পরবর্তীতে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসনের গোড়াপত্তন হয়। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে ভারতবর্ষে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
গ. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৭৯৩
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের গতি সৃষ্টি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজস্ব উদ্বৃত্ত দেখানোর জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব বোর্ড গঠন করেন এবং পাঁচসালা ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা চালু করেন। কিন্তু ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং স্থায়ী অনুরক্ত শ্রেণি সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৭৮৯ সালে দশসালা ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা চালু করেন। ১৭৯৩ সালে তিনি দশসালা বন্দোবস্তকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ঘোষণা করেন। একই সাথে নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য তিনি ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলবৎ করেন। সূর্যাস্ত আইন অনুসারে জমিদারকে একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে কোম্পানির রাজস্ব পরিশোধ করতে হতো। আর এতে অসমর্থ হলে কোম্পানি জমিদারি নিলামে বিক্রি করত। এটিই ছিল সূর্যাস্ত আইন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধি, জমির মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকার সমর্থক একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবে মুসলমান জমিদার শ্রেণির সর্বনাশ হয়, কোম্পানির আজ্ঞাবহ জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, প্রজাদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পায়।
ঘ. ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ এবং ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা লোপ
১৮৫৭ সালের ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা সিপাহি বিদ্রোহ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সিপাহি বিদ্রোহের পর এদেশে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ রাজা/রানীর শাসন শুরু হয়। ১৮৫৮ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া এক সনদের মাধ্যমে ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। এভাবে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকার সময়ে সময়ে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অন্যদিকে, ভারতীয় জনগণ জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন। সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন এর অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।