ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমালোচনা গুরো নিচে তুলে ধরা হলো-
১ . ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ অসম্ভব
ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রতিটি বিভাগ কেবল স্বীয় কার্য সম্পাদন করেই ক্ষান্ত হয় না। প্রতিটি বিভাগকে অন্যান্য বিভাগেরও কিছু কিছু কাজ এবং বিচার সংক্রান্ত কাজও করতে হয়। আবার শাসন বিভাগও কিছু কিছু আইন ও বিচার সংক্রান্ত কাজ করে থাকে। অনুরূপভাবে, বিচার বিভাগও কিছু কিছু আইন ও শাসন সংক্রান্ত কার্য সম্পন্ন করে। কাজেই ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবপর নয়।
২. ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে পৃথকীকরণ বাঞ্ছনীয় নয়
ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ বাঞ্ছনীয় নয়। সরকার এক প্রকার অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। তাই একে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা সম্ভব নয়। এ দিক হতে সরকারকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করা চলে। জীবদেহ হতে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করলে এটি যেমন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ঠিক তেমনই সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন করলে এর সুষ্ঠু কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।
৩. সরকারের বিভিন্ন বিভাগের পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে সরকারের কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রত্যেক বিভাগ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থেকে কেবল আপন আপন স্বার্থ সংরক্ষণে মনোযোগী হয়। ফলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে সরকারের কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।
৪. বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যাপক প্রয়োগ হয় না
বাস্তবক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ কোথাও তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও প্রেসিডেন্টের কোনো কোনো কাজ কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত হয়। কংগ্রেসকেও আবার কখনও কখনও প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুসারে কাজ করতে হয়। অনুরূপভাবে, সুপ্রিম কোর্টও আবার প্রেসিডেন্টের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল যদিও এটি কংগ্রেস কর্তৃক পাসকৃত যেকোনো আইনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারে; যদি উত্ত আইন সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। এভাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় একপ্রকার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি কাজ করছে। আবার ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সেখানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের চেয়ে ক্ষমতার একত্রীকরণই অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। ব্রিটেনের কেবিনেটে আইন সংক্রান্ত ও শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। আবার ব্রিটেনের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ লর্ড সভা দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় হিসেবে কাজ করে।
৫. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ একটি যান্ত্রিক পদ্ধতি তাই এর সাহায্যে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা অলীক ধারণা
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সপক্ষে বলা হয়েছে যে, এটি ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভবপর নয়। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হচ্ছে সদাজাগ্রত জনমত। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এতসব সমালোচনা সত্ত্বেও এ নীতির মূল্য অপরিসীম। ক্ষমতার অত্যধিক একত্রীকরণ শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতাই হরণ করে না, এটি সরকারকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার প্রচুর সুযোগ প্রদান করে। সরকারের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকা আবশ্যক। তবে বিচার বিভাগকে এ দুই বিভাগ হতে অবশ্যই স্বাধীন রাখতে হবে। অন্যথায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।
শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ গুলো কি কি? |
ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু (Montesquieu) তাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইংল্যান্ডের আইন বিশারদ ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone) ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর মতো ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে সমর্থন করে বলেন, ‘আইন প্রণয়ন ও আইন কার্যকর করার অধিকার যদি একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে ন্যস্ত করা হয় তা হলে সেখানে জনগণের কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না।’
ফেডারালিস্ট মেডিসন (Madison) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সপক্ষে বলতে গিয়ে বলেন, এর অনুপস্থিতিতে সরকার স্বৈরাচারী হতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি (Theory of Checks and Balances) এ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফসল। বস্তুত সকল প্রকার স্বৈরাচারী প্রবণতা হতে জনগণের অধিকারকে রক্ষাকল্পে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমালোচনা গুলো সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করলেন।