নৈতিকতা কি বা কাকে বলে?
নৈতিকতা হচ্ছে নীতি ঘটিত বা নীতি সংক্রান্ত বিষয় যা সুনীতি, সৎ নীতি বা উৎকৃষ্ট নীতিকে ধারণ করে। অন্যভাবে বলা যায়, নৈতিকতা হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা করতে এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Morality। Cambridge International Dictionary of English অনুসারে, নৈতিকতা হলো একটি গুণ যা ভালো আচরণ অথবা মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটিকে প্রত্যেক ব্যক্তিই আইন বা অন্য কোনো বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নৈতিকতা হলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত আচরণবিধি (Code of conduct)। নৈতিকতা মানুষের মনে উদ্ভব ও বিকশিত হয় এবং এটিকে সমাজ লালন করে।
নৈতিকতা সম্পর্কে উইলিয়াম সিলি বলেন, ‘মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তা, কাজের ভালো, উচিত, সঠিক শব্দমালা নীতিশাস্ত্রের নৈতিকতার মানদণ্ডের দ্বারা নির্ধারণ করা হয়।’
জোনাথান হেইট (Jonathan Haidt)-এর মতে, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ এই তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।’
আরও পড়ুন: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি কি?
অধ্যাপক নিউনার ও কিলিং বলেন, ‘নৈতিকতা হলো বিজ্ঞান ও দর্শনের সেই সকল কাজ যা মানুষের নৈতিক আচরণ, কর্তব্য এবং বিচার-বিবেচনা বিশ্লেষণ করে।’
নীতিশাস্ত্রবিদ ম্যুর নৈতিকতার একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। ম্যুর বলেন, ‘যা কিছু শুভ তার প্রতি অনুরাগ এবং অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।’
সহজ ভাষায় বলা যায়, নৈতিকতা হলো সমাজের বিবেকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কতগুলো ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের সমষ্টি।
নৈতিকতার ক্ষেত্রে বলা যায়-
১. নৈতিকতা অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা ও মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে।
২. সমাজের প্রথা, আদর্শ, ধর্ম ও ন্যায়বোধ হতে নৈতিকতার জন্ম।
৩. নৈতিকতা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
৪. নৈতিকতা লঙ্ঘন করলে মানুষকে শাস্তি পেতে হয় না। কিন্তু সামাজিক ঘৃণা বা বিবেকের দংশন এর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
৫. নৈতিকতার ধারণা সর্বজনীন। নৈতিকতার বিধানগুলো মোটামুটিভাবে সব দেশের এবং সর্বকালের। মানুষ ইচ্ছানুসারে এগুলো পরিবর্তন করতে পারে না।
৬. নৈতিকতার উদ্দেশ্য সৎ ও ন্যায়বান মানুষ সৃষ্টি করা। সেই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সার্বিক উন্নতি সাধন এবং নীতিবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
নৈতিক শিক্ষা শুরু হয় পারিবারিক ভদ্রতা, শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নিয়ম-নিষ্ঠা, সহনশীলতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে। নৈতিক গুণাবলি শিশুরা পরিবারের মধ্যেই প্রথমে শিক্ষা লাভ করে। পরবর্তীতে সামাজিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিকতার ধারণা অর্জন করে। নৈতিকতার শিক্ষা শিশুদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। শিশু তার পিতামাতা, ভাই- বোনের নিকট থেকে যে দয়া-মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা পায় অবচেতনভাবেই এটি তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। বড় হয়ে শিশুরা এ পথ অনুসরণ করে। যার ফলে শিশু দয়া-মায়া, স্নেহ, ভালোবাসার অধিকারী হয়। পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্মও নৈতিকতার উৎস হিসেবে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। তবে নৈতিকতার এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো মানুষ পরিবার, ধর্মসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকেই পেয়ে থাকে। এ ধরনের নৈতিকতাগুলো সর্বজনীন রূপ ধারণ করে। যেমন- গরিব দুঃস্থদের সাহায্য করা।
নৈতিকতার বিভিন্ন দিক
নৈতিকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. নৈতিক চেতনা: নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য দিক নৈতিক চেতনা। ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ মানুষের এ চেতনা জাগ্রত করার জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন।
২. নৈতিক মানদণ্ড: নৈতিক আদর্শের মানদণ্ড অনুসারে মানুষের কার্যক্রমের ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি নিরূপণ করা হয়।
৩. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: নৈতিকতা অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা ও মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
৪. নৈতিকতার উৎস: সমাজের প্রথা, আদর্শ, ধর্ম ও ন্যায়বোধ হতে নৈতিকতার জন্ম।
৫. সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ: নৈতিকতা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
৬. নৈতিকতা লঙ্ঘনের শাস্তি: নৈতিকতা লঙ্ঘন করলে মানুষকে শাস্তি পেতে হয় না। কিন্তু সামাজিক ঘৃণা বা বিবেকের দংশন প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
৭. সর্বজনীনতা: নৈতিকতার ধারণা সর্বজনীন। নৈতিকতার বিধানগুলো মোটামুটিভাবে সব দেশের এবং সর্বকালের। মানুষ ইচ্ছা করলেই এগুলো পরিবর্তন করতে পারে না।
৮. নৈতিকতার উদ্দেশ্য: নৈতিকতার উদ্দেশ্য সৎ ও ন্যায়বান মানুষ সৃষ্টি করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সার্বিক উন্নতি সাধন এবং নীতিবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
৯. নৈতিক বাধ্যবাধকতাবোধ: উচিত ও অনুচিতের সঙ্গে নৈতিক বাধ্যবাধকতাবোধ বিশেষভাবে জড়িত। কোনো একটি কাজকে উচিত মনে করলে তা করার এবং কোনো একটি কাজকে অনুচিত বলে মনে করলে তা না করার জন্য আমাদের একটি নৈতিকতাবোধ কাজ করে থাকে।
নৈতিকতাবোধ ও নৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ মানুষই আদর্শ মানুষ। সুতরাং যে সমাজে নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ বেশি সে সমাজব্যবস্থা আদর্শ ও কল্যাণকর হিসেবে বিবেচিত হয়।