Home » অভিধর্ম কি বৌদ্ধ দর্শন? অভিধর্মের মূল তত্ত্বকথা তুলে ধর।

অভিধর্ম কি বৌদ্ধ দর্শন? অভিধর্মের মূল তত্ত্বকথা তুলে ধর।

by TRI

প্রারম্ভিকা

দার্শনিক তত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বমূলক দেশনাই অভিধর্ম নামে অভিহিত। বৌদ্ধ সাহিত্য ত্রিপিটক নামে পরিচিত। ত্রিপিটক হল সূত্রপিটক, বিনয় পিটক ও অভিধর্ম পিটক। কিন্তু বুদ্ধের সময় সূত্র কিংবা অভিধর্ম নামে কোন স্বতন্ত্র পিটক ছিলনা। তখন বলা হত ধর্ম-বিনয়। এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতেও অভিধর্ম পিটকের উল্লেখ নেই। চুল্লবর্গ গ্রন্থে একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়ে যেখানে বুদ্ধবচন সংগ্রহের বিষয় বর্ণিত হয়েছে সেখানেও ত্রিপিটকের উল্লেখ না থাকায় এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোন কোন পন্ডিত সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু বৌদ্ধগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বুদ্ধ পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরেই ত্রিপিটক সংগৃহীত হয়েছিল। প্রথম সঙ্গীতিতে স্থবির আনন্দ ও মহাকশ্যপ কর্তৃক অভিধর্ম পিটক সংগৃহীত হয়। অভিধর্ম শব্দটি পৃথকভাবে উল্লেখ করা না হলেও এটা ধর্মসংগ্রহের সাথে যুক্ত ছিল বলে বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করেন। বৌদ্ধদের দৃষ্টিতে বুদ্ধের দর্শন অতল সমুদ্র। অভিধর্মকে বাদ দিয়ে বৌদ্ধ দর্শনের কথা কল্পনাই করা যায়না। বুদ্ধের প্রত্যেকটি কথাই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।

আরও পড়ুন:   

চতুরার্য সত্য কী? এই সত্য দর্শনের মাধ্যমে আমাদের জীবন দর্শনের যে সত্যতা তা প্রতিবেদন কর

অভিধর্ম কি বৌদ্ধ দর্শন?

ধর্ম শব্দের সাথে ‘অভি’ উপসর্গ যোগ করে অভিধর্ম পদ গঠিত হয়। ধর্ম শব্দের যেই অর্থ, অভিধর্ম অর্থও সেই অর্থ। অভি, অতি, অধি প্রভৃতি সমার্থক শব্দ। এদের অর্থ হল- অধিক, বেশি, অতিরিক্ত, বিশিষ্টতর, অধিকতর ইত্যাদি। সুতরাং শাব্দিক অর্থে অভিধর্ম হলো- বিশিষ্ট ধর্ম, অতিরিক্ত ধর্ম, অধিকতর ধর্ম। বৌদ্ধ দার্শনিক বীরেন্দ্রলাল মুৎসুদ্দীর মতে, “সূত্রের ভাষা আছে, সেই ভাষার তরঙ্গ আছে, অপায় ভয় আছে, দেব- ব্রহ্মলোকের আকর্ষণ আছে, নির্বাণের সুসমাচার আছে। অভিধর্ম যেন ভাষাহীন- শুধু ছেদন, বিশ্লেষণ, বিভাজন, পর্যবেক্ষণ এবং নৈর্ব্যত্তিক পরম সত্য জ্ঞানের উদ্ভাবন। সঙ্গে সঙ্গে চির চঞ্চল ব্যবহারিক জগতের নিরবশেষ বিলয় সাধন।”

অভিধর্ম পিটকে যে নাম-রূপের স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে, সেটাই সূত্র পিটকের সর্বসাধারনের উপযোগী করে পুনরায় ব্যাখা করা হয়েছে। এই কারণে সূত্র পিটকের ভাষা ব্যবহারিক বা ‘বোহারবচন’। যেমন- সত্ত্ব, আত্মা, জীব, জন্ম, মৃত্যু, দেব, ব্রহ্ম, আমি, তুমি, মনুষ্য ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, অভিধর্মের বিষয়বস্তু পরমার্থ সম্পর্কীয় পরমত্থবচন। যথা- স্কন্ধ, আয়তন, ইন্দ্রিয়, ধাতু, চ্যুতি, প্রতিসন্ধি, সন্ততি, আত্মা, বল, বোধ্যঙ্গ, নির্বাণ ও প্রজ্ঞপ্তি ইত্যাদি। অভিধর্ম হলো মননশীলতার চরম পরিণতি। সূত্র পিটকের ভাষা অন্য যেকোন ধর্মে কম-বেশি আলোচিত হয়েছে। এমনকি অভিধর্মের কামাবচর, রূপাবচর ও অরূপাবচর চিত্তও আলোচনা পাওয়া যায়। কিন্তু লোকোত্তর চিত্ত সম্পর্কে একমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম ব্যতীত অপর কোন ধর্মে পাওয়া যায়না। এছাড়াও স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু প্রত্যয়, নির্বাণ ইত্যাদি অভিধর্ম বিষয়াদি বৌদ্ধ ধর্ম ব্যতীত অপর কোন ধর্মে দৃষ্টিগোচর হয়না। এসব বিষয়াদি বৌদ্ধিক (জ্ঞানী) জনের মননশীলতার চরম বিকাশ বলে অভিধর্মকে বৌদ্ধ দর্শন বলা হয়।

অভিধর্মের মূল তত্ত্ব

অভিধর্মের মূল শিক্ষা যথাভূত দর্শন বা প্রজ্ঞা। সুতরাং মানুষ কি, মানুষের লক্ষ্যই বা কি, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে তার সম্বন্ধই বা কি? ইত্যাদি যথাভূত বিচার ও মীমাংসা করতে গিয়ে অভিধর্মের আলোচ্য বিষয় বা মূল তত্ত্ব চিত্ত, চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণ- এই চতুর্বিধ হয়েছে। এতে সেই লক্ষ্যের অনুকুল ও প্রতিকুল বিষয়ও হেতুমূলক বিশ্লেষণ দ্বারা প্রদর্শিত। নিম্নে অভিধর্মের মূল তত্ত্বগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলঃ

চিত্তঃ যা চিন্তা করে তাহাই চিত্ত। কি চিন্তা করে? চিত্ত বিষয় বা আলম্বন চিন্তা করে, (জড় বা অজড় যাকে অবলম্বন করে চিত্ত উৎপন্ন হয় তাই চিত্তের বিষয় বা আলম্বন বা অবলম্বন বা আরম্মণ)। এখানে চিন্তা করে অর্থ আলম্বন গ্রহণ করে, আলম্বন জানে, আলম্বন অবগত হয়। চিত্ত, মন, বিজ্ঞান একার্থ-বোধক; ইহাদের যে কোন একটি অন্য দুইটির প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়। তাহাদের লক্ষণ যথাক্রমে চিন্তন, মনন ও বিজানন; এরাও একাং, ও বোধক। আলম্বন বিজানন চিত্তের স্বভাব। চিত্ত প্রধানত চার প্রকার। যথা- কামাবচর, রূপাবচর, অরূপাবচর ও লোকোত্তর চিত্ত। চারি প্রকার চিত্তকে ভিত্তি করে উৎপন্ন মোট চিত্তের সংখ্যা একশত ঊননব্বই প্রকার।

চৈতসিকঃ চৈতসিক বা চিত্ত-বৃত্তির সংখ্যা বায়ান্ন। এরা বিভিন্ন সমবায়ে চিত্তের সাথে একসঙ্গে উৎপন্ন ও নিরোধ হয় এবং এক আলম্বন ও এক বাস্তু গ্রহণ করে। চিত্ত স্বভাবতঃ ভাম্বর; কিন্তু চৈতসিকের সংযোগে চিত্ত চৈতসিকের স্বভাবানুরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। তথাপি চিত্ত তার ‘বিজানন’ স্বভাব পরিত্যাগ করেনা। চৈতসিক চিত্তের আশ্রয় ভিন্ন উৎপন্ন হতে পারেনা। দ্বিপঞ্চ-বিজ্ঞানে শুধু সর্ব-চিত্তসাধারণ সপ্ত চৈতসিক যুক্ত থাকে। এটাই প্রকৃত চিত্ত। এটা দ্বেষ-চৈতসিক বা, লোভ-চৈতসিক বা অন্যান্য চৈতসিক বিহীন হয়ে উৎপন্ন হয়। কিন্তু দ্বেষ-চৈতসিক বা লোভ চৈতসিকাদি চিত্তের আশ্রয় ব্যতীত উৎপন্ন হতে পারেনা। এই অর্থে চিত্তই বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কারাদির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। চৈতসিক প্রধানত সাত প্রকার। যথা- সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক, প্রকীর্ণ চৈতসিক, অকুশল চৈতসিক, শোভন সাধারণ চৈতসিক, বিরতি চৈতসিক, অপ্রমেয় চৈতসিক এবং প্রজ্ঞেন্দ্রিয় চৈতসিক। এই সাত প্রকার চৈতসিককে ভিত্তি করেই উৎপন্ন চৈতসিকের সংখ্যা হয় বায়ান্ন প্রকার।

রূপঃ শৈত্যে বা উত্তাপে যার পরিবর্তন ঘটে তাই “রূপ বা জড়-পদার্থ”। রূপ ২৮ প্রকার। যথা-

১) মহাভূতরূপ মোট চারটি। যথা- পৃথিবী-ধাতু, আপ-ধাতু, তেজ-ধাতু এবং বায়ু-ধাতু।

২) প্রসাদরূপ মোট পাঁচটি। যথা- চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা এবং কায়।

৩) গোচর রূপ চারটি। যথা- রূপ, শ্রোত্র, ঘ্রাণ এবং রস।

৪) ভাব রূপ দুটি। যথা- স্ত্রীভাব ও পুংভাব।

৫) হৃদয়-রূপ একটি; যথা- হৃদয়-বাস্তু।

৬) জীবিত- রূপ একটি। যথা- জীবিতেন্দ্রিয়।

৭) আহার-রূপ একটি। যথা- কবলীকৃত আহার।

৮) পরিচ্ছেদ-রূপ একটি। যথা- আকাশ-ধাতু।

৯) বিজ্ঞপ্তি-রূপ দুটি। যথা- কায়-বিজ্ঞপ্তি ও বাক্-বিজ্ঞপ্তি।

১০) বিকার-রূপ তিনটি। যথা- লঘুতা, মৃদুতা ও কৰ্ম্মণ্যতা।

১১. লক্ষণ-রূপ চারটি। যথা- উপচয়, সন্ততি, জড়তা এবং অনিত্যতা। এরূপে এগার প্রকার রূপ স্বকীয় গুণানুসারে বিচার করতে গেলে আটাশ প্রকার হয়।

নির্বাণঃ– নির্বাণ লোকোত্তর বিষয়। যার উৎপত্তি ও বিলয় আছে তা লোকীয়। চারি আর্য মার্গ এবং চারি শ্রামণ্য ফল অর্থাৎ মার্গফল এবং অসংস্কৃত ধাতু- এসব ধর্মই লোকোত্তর। নির্বাণ তৃষ্ণা ক্ষয়, পুনর্জন্মের নিরোধ। এটা বুদ্ধের এবং বৌদ্ধদের পরম লক্ষ্য। তৃষ্ণাই দুঃখের হেতু। সুতরাং যা তৃষ্ণার নির্ব্বাণ, তা দুঃখেরও নির্ব্বাণ। তৃষ্ণাকে তৈল এবং দুঃখকে দীপ-শিখা কল্পনা করেই তৃষ্ণা-ক্ষয়ের অবস্থাকে দীপ-নির্বাণের অবস্থার উপমাকারে বলা হয়েছে। তাই ‘বান’ শব্দের সাথে ‘নি’ উপসর্গের সহযোগে নির্বাণ ধাতু গঠিত হয়। এখানে ‘নি’ অর্থ নিঃশেষ, নিরবশেষ আর ‘বান’ অর্থ বন্ধন বা তৃষ্ণা। সুতরাং তৃষ্ণার নিরবশেষ বিলয় সাধনই নির্বাণ। নির্বাণ দুই প্রকার যথা- সোপাদিশেষ নির্বাণ (জীবিতাবস্থায় লব্ধ নির্বাণ) এবং অনুপাদিশেষ নির্বাণ (মৃত্যুর পর লব্ধ নির্বাণ)। ক্লেশ, কর্ম এবং বিপাক দুঃখ হতে মুক্ত বিধায় নির্বাণ পরম শান্তির। লোভ-দ্বেষ-মোহ তথা সর্ববিধ কলুষ শূণ্য বিধায় নির্বাণকে ‘শূণ্য’ও বলা হয়।

উপসংহার

অভিধর্ম পিটকের বিষয়বস্তুগুলোর আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অভিধর্ম হল বৌদ্ধ মননশীলতার চরম বিকাশ। অভিধর্মের প্রকৃষ্ট জ্ঞান ব্যতীত কেউ উত্তম ধর্ম কথিক হতে পারেনা। কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের সাহায্যে বক্তব্য বিষয়ের বিশ্লেষণ করাই অভিধর্মের প্রধান বিশেষত্ব। দর্শন ও পরমার্থ অভিধর্মের আলোচনার প্রাণ। পরমার্থ মাত্রেই জটিল ও সাধনালভ্য। সংস্কার, মন ও কঠোর সাধনা ব্যতীত তা হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। শীলবান ব্যক্তি একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারাই এতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

Related Posts