ভূমিকা
পালি সাহিত্যে সুত্তপিটক ও বিনয় পিটকের মতো অভিধম্ম পিটকও এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। মোট ৭টি গ্রন্থ নিয়ে অভিধম্মপিটক গঠিত। যথা- ধম্মসঙ্গনি, বিভঙ্গ, ধাতুকথা, পুগগল পঞ্চত্তি, কথাবন্ধু, যমক ও পট্ঠান। এই গ্রন্থ সমূহের মধ্যে একমাত্র কথাবন্ধু ছাড়া অন্য কোনটির রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। তবে আচার্য্য পরাম্পরাগত কিংবদন্তী অনুসারে জানা যায় যে, মাতার নিকট ধর্মদেশনা করার জন্য বুদ্ধ যখন ত্রয়ত্রিংশ দেবলোকে গিয়েছিলেন তখনই মাতাকে পুরোভাগে রেখে ঋদ্ধিমান দেবগণের সামনে অভিধম্মকথা দেশনা করতে করতে ধম্মসঙ্গনি হতে আরম্ভ করে পট্ঠান পর্যন্ত এই সাতটি গ্রন্থ ‘মাতিকা’ কারে তিনি দেশনা করেছিলেন। আমাদের আলোচ্য ‘পুগ্গল পঞত্তি’ গ্রন্থটি অভিধম্মপিটকের চতুর্থ গ্রন্থ ও অভিধম্মপিটকের সব চেয়ে ছোট গ্রন্থ।
গ্রন্থ আলোচনা
পুগ্গল পঞঞত্তি গ্রন্থে সাধারণ ও বিশেষ বিভিন্ন প্রকার ব্যক্তির চরিত্র বর্ণনা আছে। বিষয়বস্তু ও বর্ণন প্রণালীর দিক্ দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে, এই গ্রন্থের সাথে অভিধম্মপিটক অপেক্ষা সুত্ত পিটকের ঘনিষ্টতা অনেক বেশী। অভিধম্মপিটকে যেভাবে বিভিন্ন ধর্ম সমূহের নির্দেশ করা হয়েছে পুগ্গল পঞত্তিতে ঐভাবে পুগ্গল পঞঞত্তি সমূহের নির্দেশ করা হয়নি। তবে অঙ্গুত্তর নিকায় ও দীর্ঘনিকায়ের ‘সংগীতিসুত্তানুসারে শুধু বুদ্ধবচনকেই ভিত্তি করে এই গ্রন্থকে আরও অধিক স্পষ্ট ও সহজবোধই করার অভিপ্রায়ে বিশ্লেষণ স্বরূপ গুণ, ধর্ম এবং স্বভাবের বৈচিত্রানুসারে ব্যক্তি সমূহের নানাবিধ স্বরূপকে বর্গাকারে বিশ্লেষিত করা হয়েছে। গ্রন্থটি ১০টি অধ্যায়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির বিশেষ আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি সূত্রপিটকের অন্তর্গত না হলেও সুত্রপিটকের অনুরূপ। এর ভাব-ভাষা প্রঞ্জর, সাধারণের বোধোপযোগী ও ব্যবহারিক।
‘পুগ্গল পঞঞত্তি’ এর অর্থ
“পুগ্গল পঞত্তি’ শব্দটি দুইটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুগ্গল’ এবং ‘পঞত্তি’। সাধারণ জ্ঞানে পুগ্গলকে ব্যক্তি; পুরুষ, সত্ত্বা, আত্মা ইত্যাদি বিশেষ আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু বিশেষ জ্ঞানে বিচার করলে দেখা যায় যে ‘পুগগল’ বলে বিশেষ কিছু নেই। এটি প্রতিমুহূর্তে নিয়ত বিলীয়মান কায়িক, চৈতসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা মাত্র।
‘পঞঞত্তি’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞাপিত করা, দর্শন করানো, প্রকাশ করা, সংস্থাপন করা এবং যথার্থ বলে সাক্ষ্য ‘দেওয়া, ধারণা, পরিচয় ইত্যাদি। অতএব, পুগ্গল পঞত্তি শব্দের অর্থ হল-পুগল বা ব্যক্তির সম্বন্ধে জ্ঞান বা পরিচিতি।
আরও পড়ুন: আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ মুক্তির পথ স্বরূপ। – কেন?
পুগ্গল প্রকারভেদ
অভিধম্মপিটকের অন্তর্গত পুগগল পঞঞত্তি গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকার পুগগলের বর্ণনা রয়েছে। যথা- সম্যক সম্বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ; আর্য-অনার্য, শৈক্ষ্য-অশৈক্ষ্য, পৃথকজন, শ্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী, অর্হত্ব প্রভৃতি।
বিভিন্ন প্রকার পুগ্গলের বিস্তারিত পরিচিতি
ক) সম্যক সম্বুদ্ধ পুগগল: যিনি অশ্রুত পূর্বক ধর্ম- চারি আর্য্য সত্যে স্বয়ংজ্ঞানার্জন করেন, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান ও দশবল জ্ঞান লাভ করেন; তিনি সম্যক সম্বুদ্ধ পুগগল নামে প্রসিদ্ধ।
খ) প্রত্যেক বুদ্ধ বা পচ্চেক বুদ্ধ পুগগল: যিনি অশ্রুত পূর্ব ধর্ম- চারি আর্য্য সত্যে স্বয়ং জ্ঞানার্জন করেন, কিন্তু সর্বজ্ঞতা জ্ঞান কিংবা দশবল জানে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারেন না; তিনি ‘প্রত্যেক’ বা ‘পচ্চেক’ বুদ্ধ নামে খ্যাত।
গ) আর্য্য-অনার্য্য পুগল: শ্রোতাপত্তি মার্গন্থ ও ফলস্থ, সকদাগামী মাগৃন্থ ও ফলন্থ, অনাগামী মার্গন্থ ও ফলস্থ অর্হত্ত্ব মার্গন্থ ও ফলন্থ- এই আট প্রকার পুগগল আর্য্য খ্যাতির অধিকারী। অপর সমস্তই অনার্য্য নামে উল্লিখিত।
ঘ) শৈক্ষ্য-অশৈক্ষ্য পুগ্গল: চার প্রকার মার্গস্থ ও তিন প্রকার ফলস্থ ব্যক্তি শৈক্ষ্য বা শিশিক্ষু নামে কথিত হন। একমাত্র অর্হৎ-ই অশৈক্ষ্য বা শিক্ষোত্তীর্ণ পুগল।
ঙ) পৃথকজন পুগ্গল: যার তিন প্রকার সংযোজন যথা-১। সৎকায়দৃষ্টি বা ব্যক্তিগত আত্মা শাশ্বত বলে দৃঢ় ধারণা, আত্মাবাদে বিশ্বাস, ২। বিচিকিৎসা বা জনন্মান্তর বাদে সংশয়, আপন জীবনের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানে সন্দেহ, ৩। শীলব্রত-পরামর্শ বা শারীরিক কৃচ্ছ সাধনা দ্বারা কিংবা অর্থহীন ব্রত-মানতাদি দ্বারা চিত্তশুদ্ধি ও মুক্তিলাভে বিশ্বাস। এই তিন সংযোজন গুলো প্রহীণ হয়নি এবং এগুলোকে পরিত্যাগ করার জন্য কোনরূপ তৎপরতাও করে না, সেইরূপ পুগ্গল পৃথকজন নামে কথিত হন।
চ) স্রোতাপন্ন পুগল: ইহলোকে কোন পুগল ত্রিবিধ সংযোজন যথা- সৎকায়দৃষ্টি, ও শীব্রত পরামর্শ সংযোজন গুলো ক্ষয় করেছেন। তিনি নরকাদি অপায় ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেন না। যিনি অনুক্ষণ সম্বোধি পরায়ণ তিনিই শ্রোতাপন্ন পুগগল। স্রোতাপন্ন পুগল তিন প্রকারে হয়, যথা- কুল-কুলান্তর, একবীজি ও সত্তঋতু পুগল।
ছ) সকৃদাগামী পুগ্গল: যিনি পূর্বোক্ত ত্রিবিধ সংযোজন ক্ষয় করে রাগ-দ্বেষ-মোহের ক্ষীণতাহেতু দেবলোকে জন্ম গ্রহণ করে তথাকার নিরূপিত আয়ুষ্কাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। অনন্তর তথা হইতে চ্যুত হয়ে একমাত্র মাত্র মনুষ্য যোনিতে আগমন করতঃ দুঃখান্ত সাধন করেন; তিনি সকৃদাগামী পুগল নামে অভিহিত।
জ) অনাগামী পুগগল: ইহলোকে কোন পুগগল পঞ্চ অধোভাগীয় সংযোজন (সৎর্কাযদৃষ্টি বিচিকিৎসা, শীব্রত পরামর্শ, কামরাগ ও ব্যাপাদ) উৎসন্ন করে ঔপপাতিক হল অর্থাৎ ‘শুদ্ধাবাস’ ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হন এবং তথায় পরিনির্বাণ লাভ করেন। (বুদ্ধ দর্শন, শীলবান ভিক্ষু দর্শন কিংবা ধর্ম শ্রবণের উদ্দেশ্যে সাময়িক আগমন ছাড়া) তথা হতে ইহলোকে জন্মহেতু পুনরাগমন করেন না। এরূপ পুগ্গল অনাগামী নামে অভিহিত।
ঝ) অর্হত্ত্ব: রূপ-রাগ, অরূপ-রাগ, মান, ঔদ্ধত্য ও অবিদ্যাকে অনবশেষ পরিহারের জন্য প্রতিপন্ন ব্যক্তি, অর্হত্ত্ব ফল লাভে নিরত এবং যাঁর রূপ-রাগ, অরূপ-রাগ, মান, ঔদ্ধত্য ও অবিদ্যা নিরবশেষ প্রহীণ হয়ে গেছে তিনিই অর্হৎ পুগগল বলে প্রখ্যাত।
উপসংহার
পালি ত্রিপিটকের তৃতীয় বিভাগ হল অভিধর্ম। বৃদ্ধের জীবদ্দশায় বুদ্ধবাণী ত্রিপিটকের বিভক্ত ছিল না। ‘ধম্ম- বিনয়’ নামেই প্রচলিত ছিল। ‘বিনয়’ হচ্ছে বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘ ও ভিক্ষণী সংঘের নিয়মকানুন বিষয়ক। বিনয় বাদে অবশিষ্ট বুদ্ধবচনকে ‘ধম্ম’ বলা হয়েছে। অতএব অভিধর্ম ‘ধর্মের’ বাইরে নয়। তদুপরি অভিধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে পালি ঐতিহ্যে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। পরিশেষে সম্রাট আশোকের রাজত্বকালে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে অভিধর্ম চূড়ান্ত আকার ধারণ হয়। অভিধর্ম ৭টি গ্রন্থে সমন্বিত। তার মধ্যে পুগ্গল পঞত্তি গ্রন্থটি সব চেয়ে ছোট ও চতুর্থ। গ্রন্থটির ১০টি অধ্যায়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির বিশেষ আলোচনা আছে। দীর্ঘনিকায়ের সংগীতি সুত্তের সঙ্গে রূপগতভাবে এর প্রভেদ অল্পই এবং গ্রন্থটির তৃতীয় থেকে পঞ্চম অধ্যায়ের অধিকাংশ অঙ্গুত্তনিকায়ে পাওয়া যায়।
তথ্যনির্দেশ:
(১) পুগগল পঞ্জঞত্তি, শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল স্থবির,
(২) পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড- ডঃ রবীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া,
৩) ত্রিপিটক সমগ্র, ডঃ জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়।