চিত্ত অভিধর্মের বিয়য়বস্তু। অভিধর্মের শিক্ষা হল যথাভূত দর্শন বা প্রজ্ঞা। সুতরাং মানুষ কি? মানুষের লক্ষণই বা কি? ইত্যাদি যথাভূত বিচার ও মীমাংসা করতে গিয়ে অভিধর্মের আলোচ্য বিষয় হল চিত্ত, চৈতসিক, রূপ ও নির্বাণ। বস্তুতপক্ষে সূত্র ও বিনয় পিটকও আমাদের শিক্ষা দেয় যে, বৌদ্ধধর্ম চিত্ত প্রধান ধর্ম। চিত্তের অবগতি সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। চিত্তের কথা বলতে গেলে চৈতসিক বা চিত্তবৃত্তের কথাও বলতে হয়। উভয়ের মিলনে চিত্তোৎপত্তি। অতএব, যার চিত্ত যত বেশি গভীর ধ্যানে লীন হয়েছে সে ততোধিক পরম শান্তিতে অবগাহন করেছে। আলোচ্য নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো চিত্ত ও চৈতসিকের স্বরূপতা তুলে ধরা।
আরও পড়ুন:
ব্রহ্মজাল বলতে কি বুঝায়? ব্রহ্মজাল সূত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর।
শ্রামণ্যফল বলতে কি বুঝ? শ্রামণ্যফল সূত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর
চৈতসিক কি?
চৈতসিক হলো চিত্তের বৃত্তি বা মনোবৃত্তি। চৈতসিক চিত্তের গঠন-উপাদান। এ চিত্তবৃত্তি সমূহ বিভিন্ন কিছুর সমবায়ে চিত্তের সাথে একসঙ্গে উৎপন্ন হয় এবং একসঙ্গে নিরুদ্ধ হয়। এরা এক আলম্বন ও এক বাস্তু গ্রহণ করে। চিত্ত স্বভাবতঃ নির্মল। কিন্তু চৈতসিক সংযোগে ভালমন্দ অবস্থা প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ শুভাশুভ কর্মের প্রতি চিত্ত ঝুঁকে পড়ে। চিত্তের আশ্রয় ছাড়া চৈতসিক উৎপন্ন হতে পারে না। কিন্তু চৈতসিকের সাহায্য ব্যতীত চিত্ত উৎপন্ন হতে পারে।
চৈতসিকের প্রকারভেদ
যেসব চৈতসিকের চিত্তোপকরণ চৈতসিক নিয়ে চিত্ত গঠিত হয় তারা সংখ্যায় বায়ান্ন। এদের প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ, প্রয়োগ ও সংগ্রহ দেখানো হয়। চৈতসিকের সংখ্যা ৫২ হলেও এদেরকে প্রধান ৭ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- ১. সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক, ২. প্রকীর্ণ চৈতসিক, ৩. অকুশল চৈতসিক, ৪. শোভন সাধারণ চৈতসিক, ৫. বিরতি চৈতসিক, ৬.অপ্রমেয় চৈতসিক, ৭. প্রজ্ঞেন্দ্রিয় চৈতসিক।
সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক
সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক বলতে বুঝায় যেসব চৈতসিক সকল প্রকার চিত্ত-উৎপত্তির সাথে যুক্ত অর্থাৎ সকল চিত্ত-ক্রিয়ার সাথে বিদ্যমান। এদের সংখ্যা ৭ টি। লৌকিক ও লোকোত্তর যত প্রকারের চিত্ত আছে, প্রত্যেক চিত্ত মূলতঃ এই সাতটি চৈতসিক নিয়ে গঠিত। এ সবই হচ্ছে চিত্তের মৌলিক উপকরণ। তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্যে এদেরকে সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক বলা হয়। যথা- ১. স্পর্শ, ২.বেদনা, ৩.সংজ্ঞা, ৪.চেতনা, ৫.একাগ্রতা, ৬.জীবিতেন্দ্রিয় ও ৭.মনস্কার।
নিম্নে সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিকের আলোচনা করা হল-
১. স্পর্শ: চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা, কায় ও মন- এ ষড়ায়তনের সহিত তাদের স্ব স্ব বিষয়ের সম্মিলন বোধই স্পর্শ। চক্ষুর সাথে রূপের, শ্রোত্রের সাথে শব্দের, ঘ্রাণের সাথে গন্ধের, জিহ্বার সাথে রসের, কায়ের সাথে স্পৃষ্ট্যের এবং মনের সাথে ধর্মের সম্মিলনে স্পর্শের উৎপত্তি হয়। মন এদের সাথে যুক্ত না হলে স্পর্শ উৎপন্ন হয় না। অতএব চক্ষু সংস্পর্শের উৎপত্তির জন্য চক্ষু, রূপ বা বর্ণ ও মন -এ ৩টির সম্মিলন আবশ্যক। আলোকাদি প্রত্যয় ও অপরিহার্য। সেরূপ শ্রোত্র-সংস্পর্শের জন্যও। এস্থলে অবশ্য বায়ু প্রত্যয় অপরিহার্য। এভাবে চক্ষু সংস্পর্শ, শ্রোত্র সংস্পর্শ, ঘ্রাণ সংস্পর্শ, জিহ্বা সংস্পর্শ, কায় সংস্পর্শ ও মন সংস্পর্শ অনুরূপ। এজন্য প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতিতে বলা হয়েছে ষড়ায়তনের প্রত্যয়ে স্পর্শ। ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সম্মিলনরূপ স্পর্শ একটি মনোবৃত্তি বা চৈতসিক। এটা সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক।
২. বেদনা: স্পর্শের প্রত্যয়ে বেদনা। যেকোন ইন্দ্রিয়ের স্পৃষ্ট আলম্বনের রসবোধক বেদনা। বেদনা অর্থ অনুভূতি বা উপলব্ধি। এ অনুভূতি বা বেদনা তিন প্রকার। যথা- সুখ-বেদনা, দুঃখ-বেদনা ও অদুঃখ-অসুখ বেদনা বা উপেক্ষা বেদনা। আবার কায় ও মন ইন্দ্রিয় ভেদে বেদনা পঞ্চবিধ। যেমন- শারীরিক সুখ বেদনা, দুঃখবেদনা এবং মানসিক সৌমনস্য, দৌমনস্য, উপেক্ষা বেদনা। এটাও একটি সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক ।
৩. সংজ্ঞা: কোন আলম্বন চক্ষাদি ইন্দ্রিয় পথে যেরূপ প্রতিভাত হয়, সেরূপ জ্ঞানই সেই আলম্বন সম্বন্ধীয় সংজ্ঞা। যেমন- অন্ধের হস্তী দর্শনের ন্যায় কেহ পদস্পর্শ করে মনে করল হস্তী স্তম্ভ সদৃশ, শুণ্ড স্পর্শ থেকে ভাবল হস্তী সর্পাকৃতি, কর্ণ স্পর্শে কুলার ন্যায় মনে করল। অন্ধের এ ধারণাই সংজ্ঞা। সংজ্ঞা আলম্বন সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান। আলম্বনের ব্যবহার, প্রয়োজন বা প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান সংজ্ঞা দ্বারা উৎপন্ন হয় না। সংজ্ঞার ক্রমোন্নতির স্তর বিজ্ঞান, অভিজ্ঞা, প্রজ্ঞা প্রভৃতি সর্বচিত্তের সাধারণ উপকরণ বলেই এটাকে সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক বলা হয়।
৪. চেতনা: যা চিন্তা করায় তা চেতনা। চেতনা সহজাত চৈতসিকগুলোকে আলম্বনে যুক্ত করে, উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে এবং কর্ম সিদ্ধির জন্য তাদেরকে প্ররোচিত করে। এটা সহজাত চেতনা। তারপর লোভ-দ্বেষ-মোহ হেতু সংযোগে এ চেতনা কর্মে পরিণত হয়। সংস্কারূপে চিত্ত-সন্ততিতে প্রচ্ছন্ন থাকে এবং সুযোগ পেলে বাক-কর্মে বা কায়-কর্মে প্রকাশিত হয়। যখন এ চেতনা দ্বারা পাপ বা পুণ্য কর্ম করা হয়, তখন এ চেতনাকে ‘নানাক্ষণিক চেতনা’ বলা হয়। কর্ম সম্পাদন কাল ও ফল-উৎপত্তিকাল বিভিন্ন বলে এটাকে নানাক্ষণিক বলা হয়। নানা অর্থে বিভিন্ন।
আরও পড়ুন:
দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় দাও। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা তুলে ধর
পুদগল শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। পুদগলের বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
৫. একাগ্রতা: একটি মাত্র বিষয়ে বা আলম্বনে চিত্তের নিশ্চল অবস্থাই একাগ্রতা। একাগ্রতা যখন পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, তখন এটা সমাধি নামে অভিহিত হয়। একাগ্র বা সমাহিত চিত্ত যথাযথ দেখতে পায়। সুতরাং জ্ঞান এটার পরিণাম ফল। মানসিক শান্তি এর রস। একাগ্রতা ব্যতীত চিত্ত তার বিষয় বা আলম্বন গ্রহণ করতে পারে না। তির্যক প্রাণীর মধ্যেও এ একাগ্রতার অঙ্কুর বিদ্যমান আছে।
৬. জীবিতেন্দ্ৰিয়: এটা চিত্তের জীবনীশক্তি। এ শক্তি চিত্ত-সন্ততির উপর আধিপত্য বা ইন্দ্রত্ব করে বলেই এটাকে জীবিতেন্দ্রিয় বলা হয়েছে। চিত্ত প্রবাহ পুনঃপুনঃ ভঙ্গ হলেও এ শক্তির বলে স্কন্ধের নির্বাণ না হওয়া পর্যন্ত বার বার উৎপন্ন হতে থাকে। অন্যান্য চৈতসিকের নিজ নিজ কৃত্য রয়েছে। এ চৈতসিকের কৃত্য হল- ঐসব চৈতসিকের উৎপত্তি-স্থিতি-ভঙ্গ পর্যন্ত পালন ও রক্ষা করা। এজন্যে অনুপালন এর লক্ষণ। জীবিতেন্দ্রিয়ই অন্যান্য চৈতসিকসমূহকে জীবনীশক্তি দান করে। এটাও সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক ।
৭. মনস্কার: এর অর্থ মনোযোগ বা মনের ক্রিয়া। চিত্ত যে আলম্বন গ্রহণ করে, এ বিষয়ে তার নিত্য সহায় মনস্কার। চেতনা আলম্বন নির্দেশ করে, কিন্তু মনস্কার সেই আলম্বনের প্রতি লক্ষ্য রাখে। মনস্কার চিত্তকে আলম্বন শূন্য হতে দেয় না। মনস্কারের দ্বারা চিত্তের প্রথম ক্রিয়া আরম্ভ হয়। মনস্কার সারথি সদৃশ। সারথি যেমন অশ্বকে লক্ষ্য স্থলে বা গন্তব্য স্থানে পরিচালনা করে, এ মনস্কারও চিত্তকে আলম্বনে পরিচালনা করে। মনস্কারও একটি সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, চৈতসিক হলো বাহ্যিক আলম্বন। বাইরের নানা প্রকার ছাপ চিত্তে পতিত হয়ে নিত্য নতুন নতুন চিত্ত উৎপন্ন করায়, ঠিক যেন নানাবিধ রং মিশ্রণে পানি স্বীয় স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের চিত্তও বাইরের ছাপে সংস্কার অবস্থা প্রাপ্ত হয়।