ভূমিকা
সূত্তপিটকের দ্বিতীয় বিভাগ বা সূত্র সংগ্রহ মজঝিম নিকায় বা মধ্যম নিকায়। এতে মোট ১৫২টি সূত্র আছে। সূত্রগুলো তিন খণ্ডে বিভক্ত। মজঝিম নিকায়ের সূত্রগুলো আকারে দীর্ঘনিকায়ের সূত্রগুলোর তুলনায় ক্ষুদ্রতর হলেও প্রত্যেকটি সূত্র স্বয়ং সম্পূর্ণ। মধ্যম নিকায়ের অন্তর্গত গনকমোগ্গলায়ন সূত্রে বৌদ্ধ আদর্শে কিভাবে সাধারণ স্তর থেকে শিক্ষায় ক্রমিক প্রগতি অর্জন করে চতুর্থ ধ্যান স্তরে পৌঁছে অর্হত্ত্ব লাভ করা যায় তার ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়।
গনকমোগ্গল্লায়নের পরিচয়
গনকমোগ্গলায়ন ছিলেন তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ সম্প্রদায়ের একজন আদর্শ পণ্ডিত ব্রাক্ষ্মণ। তিনি ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ক্রমশিক্ষাপদ্ধতির সাথে তথাগত শিক্ষা পদ্ধতির কোন সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় কি না তা জিজ্ঞাসা করতে তথাগত সমীপে উপস্থিত হয়ে তথাগত শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন প্র্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন। এই ব্রাক্ষ্মণ ছিলেন তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ সমাজের একজন আদর্শ শিক্ষক। সে সময়ে তাঁর আশ্রমে অনেক শিষ্য-প্রশিষ্য ছিল।
গনকমোগ্গল্লায়ন সূত্রের বিষয়বস্তু
গনকমোগ্গলায়ন ব্রাক্ষ্মণ শ্রাবস্তী সমীপে মিগার মাতার প্রাসাদে তথাগত বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে কুশলা-কুশল জিজ্ঞাসার পর প্রশ্ন করলেন- হে তথাগত! আমাদের ব্রাক্ষণদের মধ্যে অধ্যায়নের অনুপূর্ব শিক্ষা, অনুপূর্ব ক্রিয়া, সর্বোপরি অনুপূর্ব প্রগতি দেখা যায়। যা তীরদাজদের তীর চালনা বিষয়েও প্রচলিত আছে। শুধু তাই নয়, আমরা প্রথমে শিক্ষার্থী লাভ করলে তাকে শিক্ষার প্রথমার্ধে এক একটি, দুই দুইটি, তিন তিনটি এভাবে শত পর্যন্ত গণনা করার শিক্ষা দিয়ে থাকি। বহু গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত আপনার ধর্ম বিনয়েও কি একই পদ্ধতি প্রচলিত আছে? তথাগত ভগবান বুদ্ধ ব্রাক্ষ্মণের প্রশ্নের উত্তরে একে একে প্রত্যকটি তথাগত প্রবর্তিত ক্রমিক শিক্ষা পদ্ধতি আলোচনা করলেন।
বুদ্ধের ক্রমশিক্ষা পদ্ধতি
গনকমোগ্গলায়ন ব্রাক্ষণের যে শিক্ষা পদ্ধতি তা লৌকিক শিক্ষা পদ্ধতি। আর তথাগতের শিক্ষা পদ্ধতি লোকোত্তর মার্গে পদার্পন করার পদ্ধতি। ব্রাক্ষ্মণের প্রশ্নের উত্তরে তথাগত বলেছিলেন- হে ব্রাক্ষ্মণ! তথাগতের ধর্ম বিনয়েও অনুপূর্ব শিক্ষা, অনুপূর্ব ক্রিয়া এবং অনুপূর্ব প্রতিপদ প্রজ্ঞাপন করা সম্ভব। তবে আমার এই শিক্ষা পদ্ধতি ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা একজন দক্ষ অশ্ব দমক উত্তম জাত অশ্বজ্ঞান লাভ করে প্রথমে লাগাম ধারণের শিক্ষা দেন ও পরে পরবর্তী শিক্ষাগুলো দিয়ে থাকেন।
প্রথম শিক্ষার পদ্ধতি
এসো ভিক্ষু শীলবান হও, শীলবান হয়ে পাতিমোক্ষ সংবরণ শীল দ্বারা নিজেকে আবৃত করো। বিন্দু পরিমাণ দোষে ও ভয়দর্শী হয়ে বিহার করবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিক্ষাপদ সমূহ ও শিক্ষা করে আচার গোচর সম্পন্ন হয়ে বিহার করবে।
দ্বিতীয় শিক্ষাপদ্ধতি
এসো ভিক্ষু ইন্দ্রিয় গুপ্তদ্বার সংযত করো, যেকোন রূপে অভিভূত হয়ো না। চক্ষুইন্দ্রিয়ে অসংযত হয়ে বিহার করলে অবিদ্যা, দৌর্মণস্য, পাপ এবং অকুশল কর্ম বৃদ্ধি পায়। তাই চক্ষুইন্দ্রিয়ে সংযত হয়ে বিহার করো। তেমনিভাবে শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ, শরীর এবং মন সম্পর্কেও তদ্রুপভাবে বিহার করবে।
তৃতীয় শিক্ষাপদ্ধতি
এসো ভিক্ষু! এবার ভোজনে মাত্রাজ্ঞান হয়ে অবস্থান করো, গভীর মনোযোগ সহকারে আহার করো। কেননা এই আহার শরীর উত্তেজনার জন্য নয়, শরীর বৃদ্ধির জন্য নয়, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য নয়, এই আহার শুধু জীবন ধারণের জন্যে, এই আহার খেয়ে বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে নিজেকে রক্ষার মাধ্যমে সুন্দর ব্রক্ষ্মচর্য পালন করার উপায় হয়। যাতে পুরাতন বেদনা প্রতিহত করে নতুন বেদনা উৎপন্ন হতে না পারে। তাই ভিক্ষুগণ তোমরা ভোজনে মাত্রাজ্ঞান রাখবে।
চতুর্থ ক্রমশিক্ষা পদ্ধতি
এসো ভিক্ষু জাগরণে অনুযুক্ত হয়ে বিহার করো। দিনের বেলায় চংক্রমণ এবং উপবেশনে আবরণীয় ধর্ম প্রতিপালন করে চিত্ত পরিশুদ্ধ করো, শুধু তাই নয়, রাতের প্রথম প্রহরে পায়ের উপর পা রেখে স্মৃতিমান হয়ে যথাসময়ে জাগরণিত হওয়ার জন্য মনস্কামনা করে দক্ষিণ পার্শ্বে সিংহশয্যা গ্রহণ করো। আবার রাতের শেষ প্রহরে চংক্রমণে এবং উপবেশনে আবরণীয় ধর্ম হতে চিত্ত পরিশুদ্ধ করো। এভাবে জাগরণে মাত্রাজ্ঞান লাভ করো।
পঞ্চম ক্রমশিক্ষা পদ্ধতি
এসো ভিক্ষু এবার সম্প্রজ্ঞান হয়ে অবস্থান করো, গমনে প্রতিগমনে, আলোকনে, বিলোকনে, সন্ধোতনে, প্রসারণে, সংঘাটি পাত্র চীবর ধারণে, ভোজনে, পানে, খাদনে, আস্বাদনে, মলমূত্র ত্যাগে, স্থিতিতে, উপবেশনে, শয়নে, জাগরণে, প্রত্যেক বিষয়ে স্মৃতি সম্প্র্রজ্ঞান হয়ে অবস্থান করে ব্রক্ষ্মচর্য পালন করবে।
ষষ্ঠ ক্রমশিক্ষা পদ্ধতি
এসো ভিক্ষু নির্জন শয়নাসন ভজনা করো অর্থাৎ অরণ্য, বৃক্ষমূল, পর্বতবন্দর, গিরিগুহা, শশ্মান, বনখণ্ড, উন্মুক্ত প্রান্তর, পলাল পুজ্ঞ, ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে প্রত্যাগমন করলে ভুক্তাবসানে পদ্মাসন করে দেহের অগ্রভাগ সোজাভাবে স্মৃতি উপস্থাপিত হয়ে অবস্থান করবে, চিত্ত থেকে সমগ্র অবিদ্যা ত্যাগ করে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে চিত্তকে সর্বজীবের প্রতি কল্যাণ কামনায় পরিশুদ্ধ করবে।
এইভাবে একজন দমনীয় পুরুষ যদি ক্রমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তাহলে তিনি চিত্তের পঞ্চনীবরণ পরিহার করে অকুশল কর্ম হতে মুক্ত হয়ে প্রথম ধ্যানে অবস্থান করেন। তারপর চিত্তের বিতর্ক বিচার উপশমে দ্বিতীয় ধ্যান, উপেক্ষা সম্পন্ন ও স্মৃতিমান হয়ে তৃতীয় ধ্যানে এবং সর্বশেষে দৈহিক সুখ, দুঃখ পরিহার করে সৌমনষ্য ও দৌমনষ্য পরিহার করে চতুর্থ ধ্যানে অবস্থান করেন। একজন ভিক্ষু এইভাবে সকল তৃষ্ণা ক্ষয় করে ক্রমিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাণ সাক্ষাত করেন।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, তথাগতের ক্রমিক শিক্ষার পদ্ধতি গনকমোগ্গলায়ন ব্রাক্ষ্মণের শিক্ষা পদ্ধতির চাইতে ভিন্ন প্রকৃতির শিক্ষা পদ্ধতি। ব্রাক্ষ্মণের শিক্ষা পদ্ধতি লাভ করে লৌকিক জ্ঞান লাভ করা যায় আর তথাগতের শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে জীবন সত্য উপলব্ধির মাধ্যমে মুক্তিমার্গে উপনীত হওয়া যায়।
অন্যান্য লেখা:
পঞ্চশীল গুলো কি কি? পঞ্চশীল পালনের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি আনয়ন সম্ভব – এই উক্তির সত্যতা প্রমাণ কর।
খুদ্দক পাঠের একটি সম্যক ধারণা দাও এবং কুমার প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব আলোচনা কর
করনীয় মৈত্রী সূত্রটি কেন আবৃ্ত্তি করা হয়েছিল? এ সূত্রের সারমম তুলে ধর