দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় – দারিদ্র্য বাংলাদেশের এক তীব্র ও জটিল সমস্যা। এর পিছনে বহুবিধ কারণ ক্রিয়াশীল এবং এর নেতিবাচক প্রভাবও ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বহুমুখী ও পরস্পরনির্ভর বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এটি মোকাবিলা করা যেতে পারে। নিচে দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় সমূহ তুলে ধরা হলো :
১। জরিপ ও গবেষণা
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সর্বাগ্রে এর উপর সামাজিক জরিপ ও গবেষণা পরিচালনা করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে দারিদ্র্যের কারণ, ব্যাপকতা, প্রভাব, সম্ভাব্য সমাধানের উপায় প্রভৃতি নির্ধারণ করতে হবে।
২। জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনা
জরিপ ও গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা (স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ) বাস্তবায়নের জাতীয়ভিত্তিক কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
৩। উৎপাদন খাতের বিস্তার
দারিদ্র্য নিরসনে দেশে উৎপাদনমুখী খাতের প্রসার ঘটাতে হবে। সে সাথে সামরিক ও মাথাভারী প্রশাসনসহ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
আরও পড়তে পারেন:
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ সমূহ
দারিদ্র্য কাকে বলে? দারিদ্র্যের প্রকারভেদ আলোচনা কর
৪। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে জোরদার ও ফলপ্রসূ করে পর্যায়ক্রমে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে।
৫। কৃষি উন্নয়ন
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের দারিদ্র্য মোকাবিলায় কৃষি উন্নয়ন অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন, জীবনমান উন্নয়ন, ঘাটতি পূরণ, আমদানি হ্রাস ও অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করা সম্ভব । এছাড়া খাদ্য ও বন্ধকী জমি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করতে হবে।
৬। শিক্ষা উন্নয়ন
বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের সকল নাগরিকের সুশিক্ষার ব্যবস্থাসহ শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ উৎপাদনমুখী ও জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে।
৭। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও রপ্তানি
আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনসংখ্যাকে রপ্তানি করেও দারিদ্র্য বিমোচন করা যায়।
৮। শিল্পায়ন
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালীকরণে ব্যাপক শিল্পোন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশের চাহিদা পূরণ, কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদ সদ্ব্যবহার এবং আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন অপরিহার্য ।
৯। কর্মসংস্থান সৃষ্টি
শিল্পায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণে নিবিড় শ্রমযুক্ত অকৃষি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীদেরও সুযোগ দিতে হবে এবং পল্লী এলাকায় কর্মহীন মৌসুমে অবকাঠামোগত নির্মাণ, স্ব- কর্মসংস্থান, কুটির শিল্পের প্রসার প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০। সম্পদের সদ্ব্যবহার
দারিদ্র্য নিরসনকল্পে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের সুষ্ঠু আহরণ ও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। খনিজ, বনজ, জলজ, সৌর প্রভৃতি সম্পদসমূহ সদ্ব্যবহার ও অপচয়রোধ করে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।
১১। বৈষম্য হ্রাস ও সুষম বণ্টন
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ধনী-গরিবের মধ্যকার ব্যবধান কমাতে হবে এবং প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টন করতে হবে। প্রয়োজনে ধনীদের উপর করারোপ ও দারিদ্র্যদের ভাতা দিতে হবে।
১২। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন একান্ত প্রয়োজন । স্থিতিশীলতার মাধ্যমে জনগণকে উন্নয়নে ও কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োগ করা সম্ভব হবে।
১৩। নারী উন্নয়ন
নারীদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায়, মনমানসিকতায় উন্নত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সক্রিয় আন্দোলনে দরিদ্রদের ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে যাতে নারীরা দেশ। উন্নয়নে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১৪ । সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি
আমাদের দেশ হতে দারিদ্র্য দূর করতে হলে দেশে প্রচলিত সকল প্রকার সামাজিক, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করতে হবে।
১৫। ভূমি সংস্কার নীতি
বর্তমানে এদেশে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষির পরিমাণই বেশি। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু ভূমি সংস্কার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বর্তমান ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীর ভাগ্যের পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে হবে।
১৬। বাজার সম্প্রসারণ
মুক্ত বাজার অর্থনীতির আওতায় বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে এদেশের রপ্তানি বাজারকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। আমদানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে হবে।
১৭। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি
দেশকে দারিদ্র্যের কষাঘাত হতে মুক্তি দিতে হলে প্রয়োজন প্রচুর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। ফলে উৎপাদন বাড়বে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
১৮। আত্মকর্মসংস্থান
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দেশের সকল লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সরকারি- বেসরকারি সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বা পরিবেশ করে দিতে হবে যাতে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফল হয় ।
১৯। সম্পদ পাচার রোধ
বৈধ-অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া সম্পদকে রোধ করতে হবে। ফলে আপনা আপনিই মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়বে এবং দারিদ্র্যের প্রকোপ হ্রাস পাবে।
২০। আইন শৃঙ্খলার উন্নয়ন ও দুর্নীতি রোধ
দেশের আইন-শৃঙ্খলার সঠিক প্রয়োগ তথা দেশের সর্বস্তর হতে দুর্নীতির মাত্রা হ্রাস করতে পারলে দারিদ্র্যের প্রকোপও হ্রাস পাবে।
উপর্যুক্ত বহুমুখী ও বিস্তৃত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন বা দূরীকরণ করা সম্ভব । অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচন বা দারিদ্র্য দূরীকরণের উপরিউক্ত সুপারিশসমূহ পেশ করা যায়।