আর্থিক নীতি বা মুদ্রা নীতি
যে নীতির সাহায্যে দেশের মুদ্রাব্যবস্থা পরিচালনা এবং মুদ্রা ও ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে মুদ্রা বা আর্থিক নীতি বলে। একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতিসমূহের অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে মুদ্রানীতি। অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মুদ্রানীতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে অর্থ ও ঋণের প্রাপ্যতা, সংশ্লিষ্ট ব্যয় নিয়ন্ত্রণকে সাধারণভাবে আর্থিক নীতি হিসাবে গণ্য করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে থাকে।
আর্থিক নীতির সংজ্ঞা
নিম্নে কয়েকজনের অর্থনীতিবিদের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-
- অধ্যাপক জনসন-এর মতে, “সাধারণ অর্থনৈতিক নীতির সাথে জড়িত উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত মুদ্রার যোগানের উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে মুদ্রানীতি বলে।”
- ড. পল এনজিগ বলেন, “আর্থিক ও অনার্থিক লক্ষ্যে পরিচালিত সব রকমের আর্থিক ও অনার্থিক সিদ্ধান্ত এবং গৃহীত পদক্ষেপ যাদের দ্বারা দেশের অর্থ ব্যবস্থা প্রভাবিত হয় তাদের সমন্বিত রূপায়ণকে আর্থিক নীতি বলে।”
- আর. পি. কেন্ট বলেন, “পূর্ণ নিয়োগের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচলিত অর্থ যোগানের পরিমাণ হ্রাসবৃদ্ধি পরিচালনার নীতিকে আর্থিক নীতি বলে।”
সুতরাং বলা যায়, যে নীতির সাহায্যে অর্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ও কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা যায় তাকে মুদ্রা নীতি বলে।
আরও পড়ুন: রাজস্ব নীতি কি? রাজস্ব নীতির হাতিয়ার গুলো কি কি?
আর্থিক নীতির ধরন
সরকার ও আর্থিক কর্তৃপক্ষ যে সব নীতিমালা গ্রহণ করে তার সমষ্টিকে আর্থিক নীতি বলা হয়। আর্থিকনীতি বা মুদ্রা নীতি তিন ধরনের হয়। যথা :
১। সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি
অর্থনীতিতে অর্থ ও ঋণের যোগান বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত আর্থিক নীতিকে সম্প্রসারণ মুদ্রানীতি বলা হয় । এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে আয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।
২। সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি
অর্থনীতিতে অর্থ ও ঋণের যোগান কমানোর জন্য গৃহীত আর্থিক নীতিকে সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি বলে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও আয় হ্রাস পায়, চাহিদা হ্রাস পায়, দামস্তর হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
৩। নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি
যে ধরনের আর্থিক নীতি অর্থনীতিতে আয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, চাহিদা, প্রভৃতি প্রকৃত উপাদানকে প্রভাবিত করে না তাকে নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি বলা হয়। মূলত পূর্ণনিয়োগ স্তরে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নিরপেক্ষ আর্থিকনীতি গ্রহণ করা হয়।
আর্থিক নীতির হাতিয়ার
আর্থিক কর্তৃপক্ষ অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে সব উপায় অবলম্বন করে বা করতে পারে তাদেরকে আর্থিক নীতির হাতিয়ার বলা হয় । আর্থিক নীতির হাতিয়ার সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো :
১। ব্যাংক হার
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার সদস্য ব্যাংকগুলোকে যে সুদের হারে ধার প্রদান করে তাকে ব্যাংক হার বলে। কোন দেশের মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ব্যাংক হার বৃদ্ধি বা হ্রাস করে মুদ্রার যোগান অনেকটা বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে পারে।
২। ন্যূনতম রিজার্ভ অনুপাত
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের যোগান বা ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তার রিজার্ভ নীতি অনুসরণ করতে পারে। প্রতিটি দেশের তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো এদের মোট আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। যে পরিমাণ অর্থ সদস্য ব্যাংকসমূহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে তাকে ন্যূনতম রিজার্ভ বলা হয়। এ রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস পায়। আবার রিজার্ভের পরিমাণ কমলে ঋণদান ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই আর্থিক নীতির বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকে ।
৩। মুদ্রার ইস্যু নিয়ন্ত্রণ করা
অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা আর্থিক নীতির প্রধান উপকরণ। অর্থের যোগান ও চাহিদার মধ্যে তারতম্য দেখা দিলে অর্থনীতিতে বহুরূপী সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ জন্য আর্থিক কর্তৃপক্ষ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের গতি প্রকৃতি ইত্যাদি ভিত্তিতে অর্থের চাহিদার সাথে তার যোগানের সংগতি রাখার জন্য শক্তিশালী মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
৪। খোলাবাজার নীতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর নিকট হতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্র ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির সময় সদস্য ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র বিক্রয় এবং মুদ্রা সংকোচনের সময় ঋণপত্র ক্রয় করে অর্থ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতির উল্লিখিত চারটি হাতিয়ার ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিচের হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করে
(ক) খণ্ডকালীন ঋণ ব্যবস্থা : এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
(খ) ঋণের প্রয়োজনীয় মার্জিন পরিবর্তন : এর বৃদ্ধি বা হ্রাসের দ্বারা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে ঋণের পরিমাণ হ্রাস বা
(গ) সুদ ও ঋণের সীমা নির্ধারণ : বাজারে অর্থ সরবরাহের অবস্থা বুঝে বিভিন্ন ঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সুদ এবং বৃদ্ধি করতে পারে। ঋণের পরিমাণ কমবেশি নির্ধারণের জন্য এ নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
(ঘ) প্রচারণা : কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনগণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এটি সদস্য ব্যাংক এবং সংকোচনের শুভ-অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে পারে। তাই এ হাতিয়ারকে মনস্তাত্ত্বিক অর্থ বাজারের ঋণের সম্প্রসারণ ও হাতিয়ার বলা যেতে পারে।