রাজস্ব নীতি কি?
অর্থনীতির যে শাখায় সরকারের আয়, ব্যয় এবং ঋণ সংক্রান্ত নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে রাজস্ব নীতি বলে । অর্থাৎ সরকার মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে এক বছরের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে আয়-ব্যয়ের নীতি গ্রহণ করে তাই রাজস্ব নীতি । অর্থনীতিতে করের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে যেমন জাতীয় আয় হ্রাস পায়, অন্যদিকে অর্থনীতিতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেলে জাতীয় আয়ও বৃদ্ধি পায়। ল্যাটিন শব্দ ফিস্ক (Fisc) এর অর্থ হলো রাজকোষ বা রাষ্ট্র কোষাগার। অর্থাৎ সরকারের ঐ রাজকোষ পরিচালনার নীতি হলো রাজস্ব নীতি ।
রাজস্ব নীতির সংজ্ঞা
রাজস্ব নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
- অধ্যাপক আর. ডব্লিউ. লিন্ডহা-এর মতে, “সরকারের ব্যয় এবং আয় সংক্রান্ত পদ্ধতি, সময় এবং নীতিকে রাজস্ব নীতি বলে। “
- অর্থনীতিবিদ হিকস্-এর মতে, “রাজস্ব নীতি হলো এমন একটা নীতি যা অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারি অর্থব্যবস্থার যাবতীয় উপাদানকে কাজে লাগায়।”
- অর্থনীতিবিদ আর্থার স্থিথিস-এর মতে, “যে সকল নীতির আওতায় সরকার জাতীয় আয়, উৎপাদন ও নিয়োগের উপর বিরূপ প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কর্মসূচি ব্যবহার করে, তাকে রাজস্বনীতি বলে।”
- অধ্যাপক টেইলর-এর মতে, “ফিস্ক শব্দটির অর্থ হলো রাজস্বকোষ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কোষাগার যেসব নীতি নির্ধারণ করেন সামগ্রিকভাবে তাদের রাজস্বনীতি বলা যেতে পারে।”
অতএব উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, অর্থনীতির যে শাখায় সরকারের আয় সংগ্রহ, ঋণ সংগ্রহ, কর সংগ্রহ, এবং সরকারি ব্যয় নির্বাহ ইত্যাদি নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে রাজস্ব নীতি বলে।
রাজস্ব নীতির হাতিয়ার সমূহ
“কোন দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার যে সকল পদ্ধতি বা কৌশলে অবলম্বন করে। সেগুলোকে রাজস্ব নীতির হাতিয়ার বা উপকরণ বলে। নিচে রাজস্ব নীতির বেশকিছু হাতিয়ার আলোচনা করা হলো :
১। সরকারি ব্যয়
সরকারি ব্যয় হচ্ছে রাজস্বনীতির প্রধান হাতিয়ার। সরকার দেশের জনগণের প্রয়োজনে বিভিন্ন খাতে ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। যেমন : দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য খাদ্যদ্রব্য ঔষধ ক্রয় তাছাড়াও বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, পেনশন ইত্যাদি হস্তান্তর পাওয়া বাবদ সরকার প্রচুর অর্থব্যয় করে থাকে। উক্ত ব্যয় ছাড়াও সরকার দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় করে থাকে। সরকারি ব্যয়ের এসব অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২। কর রাজস্ব
সরকারি আয়-ব্যয় তথা রাজস্ব নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো কর রাজস্ব। সরকার তার কর নীতির মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রা তথা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারে। মন্দার সময়ে সরকার শিক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং আমদানির উপর কর কমিয়ে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং সমৃদ্ধির সময়ে কর নীতির পরিবর্তন করতে পারে।
৩। সরকারি ঋণ
যদি কোন সরকার আর্থিক প্রয়োজনে ঋণপত্র বিক্রয় করে অথবা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কিংবা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে তখন তাকে সরকারি ঋণ বলে। সরকার জনগণের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে বলে জনগণের অর্থ-রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার দরুন মূল্যস্তর কমে যায়। অর্থাৎ সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা আবার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় করে থাকে।
৪। ভর্তুকি
সরকার যখন কোন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সচল রাখার জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। তখন তাকে ভর্তুকি (Subsidy) বলে। সরকার অনেক সময় জনগণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে অপেক্ষাকৃত কম দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করার উদ্দেশ্যে উৎপাদনকারীকে ভর্তুকি প্রদান করে। মোটকথা সরকার ভোক্তা ও উৎপাদনের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্যই ভর্তুকির আশ্রয় নেয়। অতএব ভর্তুকিও রাজস্বনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ।
৫। বাধ্যতামূলক সঞ্চয়
বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ও রাজস্বনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার ঋণপত্র বিক্রয় অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের অংশবিশেষ বাধ্যতামূলকভাবে কল্যাণ তহবিলে জমা রাখতে পারে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি রোধের পাশাপাশি উৎপাদন ও আয় নিয়োগের উপর প্রভাব পড়বে।
৬। নতুন কর নীতি
রাজস্ব সংগ্রহের উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে করনীতি। সরকার অনেক সময় বাজেটের ব্যয় নির্বাহের জন্য নতুন নতুন কর ক্ষেত্র তৈরি করে। ফলে সরকারের “কর” সংগ্রহের আওতা বৃদ্ধি পায়। সরকার নতুন কর ক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করে।
৭। বাজেট
অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা আনতে বাজেট একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বাজেট দ্বারা রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন করা হয়। যেমন :
(ক) বার্ষিক ভারসাম্য বাজেট;
(খ) চক্রবৃদ্ধি ভারসাম্য বাজেট;
(গ) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিপূরণমূলক বাজেট।
৮। গণপূর্ত
রাজস্ব নীতির অন্যতম হাতিয়ারগুলোর আরেকটি হলো গণপূর্ত কার্যক্রম। কেইন্স এ নীতির সমর্থক। মন্দাকারে গণপূর্তের সাহায্যে-
(ক) শ্রমিকদের মেধার অপব্যবহার রোধ করে;
(খ বেকার শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে;
(গ) এটি বেসরকারি বিনিয়োগের পথ উন্মোচন করে;
(ঘ) । আর্থিক সামাজিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে;
(ঙ) জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ।
উপরোক্ত হাতিয়ারগুলোর মাধ্যমে সরকার তার কর হারের পরিবর্তন এবং ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে রাজস্ব নীতি কার্যকর করে থাকে।
আরও পড়ুন:
শিশু শ্রম কি? বাংলাদেশে শিশু শ্রম প্রতিরোধের উপায় আলোচনা কর
মজুরি কাকে বলে? আর্থিক মজুরি ও প্রকৃত মজুরির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ আলোচনা কর
মুদ্রাস্ফীতি কি ? বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ গুলো কি কি ?