মজুরি কি ?
সাধারণ অর্থে শ্রমিকের পারিশ্রমিককে মজুরি বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে মজুরি শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোন শ্রমিক উৎপাদন কাজে নিযুক্ত থেকে তার শারীরিক ও মানসিক শ্রম প্রদান করে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে তাকে মজুরি বলে। যেমন : ডাক্তার, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক তারা নিজ নিজ পেশায় নিযুক্ত থেকে অর্থ উপার্জন করে। এ ধরনের পারিশ্রমিককেই মজুরি বলে।
অধ্যাপক বেনহাম-এর মতে, “চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার জন্য নিয়োগকর্তা শ্রমিককে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাকে মজুরি বলে।” (Wages may be difine as a sum of money paid under contract by an employer to a worker for services rendered Benham)। অনেকের ধারণা শুধু অন্য কোন ব্যক্তির অধীনে কাজ করলে মজুরি পাওয়া যায় । কিন্তু এ কথাটি ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করেও মজুরি পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি নিজের ভূমিতে বা কারখানায় কাজ করেও মজুরি লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি অন্যের ভূমি বা কারখানায় কাজ করলে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতো এটিই হবে তার মজুরি। মজুরি সাধারণত দুই ধরনের হয়। যথা-
সময়ভিত্তিক মজুরি (Time wages): কোন শ্রমিক কোন নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে কাজ করার জন্য নিয়োগকর্তা তাকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাকে সময়ভিত্তিক মজুরি বলে। যেমন: একদিন, এক সপ্তাহ, এক মাস ইত্যাদি। অর্থাৎ একজন শ্রমিক ১ দিন কাজ করে ১৫০ টাকা মজুরি পায়। এক্ষেত্রে ১৫০ টাকা হলো সময়ভিত্তিক মজুরি।
কর্মভিত্তিক মজুরি (Piece wages) : কাজের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে নিয়োগকর্তা শ্রমিককে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাকে কর্মভিত্তিক মজুরি বলে। যেমন একটি খাতা বাঁধাই করে ৫ টাকা মজুরি পায়। সে প্রতিদিন ২০টি খাতা বাঁধাই করতে পারে।
সুতরাং তার কর্মভিত্তিক মজুরি হবে = (৫ x ২০ = ১০০) টাকা
মজুরির প্রকারভেদ
মজুরি দুই প্রকার । যথা : (ক) আর্থিক মজুরি; (খ) প্রকৃত মজুরি। নিচে তা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো :
(ক) আর্থিক মজুরি (Money wages)
কোন শ্রমিক কোন নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার ফলে নিয়োগকর্তা তাকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাকে আর্থিক মজুরি বলে। যেমন : কোন শ্রমিকের ১ মাসের বেতন হলো ৫,০০০ টাকা। এ ৫,০০০ টাকা হলো শ্রমিকের আর্থিক মজুরি।
(খ) প্রকৃত মজুরি (Real wages)
কোন শ্রমিক তার উপার্জিত আর্থিক মজুরি দ্বারা যে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম ক্রয় করতে পারে এবং আর্থিক মজুরি ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে তাকে প্রকৃত মজুরি (Real wages) বলে । যেমন : কোন শ্রমিকের এক মাসের বেতন হলো ৫,০০০ টাকা। শ্রমিক এ ৫,০০০ টাকা আর্থিক মজুরি ছাড়াও বিনামূল্যে বাসস্থান, চিকিৎসা সুবিধা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, ছাতা, টর্চ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ শ্রমিকের এক মাসের বেতন ৫,০০০ টাকা। এ ৫,০০০ টাকা হলো শ্রমিকের আর্থিক মজুরি এবং ৫,০০০ টাকার বিনিময়ে যে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করা ছাড়াও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করে এদের সমষ্টিই হলো প্রকৃত মজুরি।
আরও পড়ুন: মুদ্রাস্ফীতি কি বা কাকে বলে ? বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ
আর্থিক মজুরি ও প্রকৃত মজুরির মধ্যে পার্থক্য
আর্থিক মজুরি ও প্রকৃত মজুরির যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থক্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :
১। কোন শ্রমিক কোন নির্দিষ্ট সময় কাজ করার ফলে নিয়োগকর্তা তাকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে তাকে আর্থিক মজুরি বলে । পক্ষান্তরে, কোন শ্রমিক তার উপার্জিত আর্থিক মজুরির যে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম ক্রয় করতে পারে এবং আর্থিক মজুরি ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে তাকে প্রকৃত মজুরি বলে।
২। আর্থিক মজুরি অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা যায়। পক্ষান্তরে, প্রকৃত মজুরি দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সাহায্যে পরিমাপ করা যায়। ৩। আর্থিক মজুরি দ্বারা কোন শ্রমিকের প্রকৃত জীবনযাত্রার মান নির্ণয় করা যায় না। পক্ষান্তরে, প্রকৃত মজুরি দ্বারা কোন শ্রমিকের প্রকৃত জীবনযাত্রার মান নির্ণয় করা যায় ।
৪ । আর্থিক মজুরি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের তেমন আকর্ষণ করে না। পক্ষান্তরে, প্রকৃত মজুরি কর্মক্ষেত্রে বেশি আকর্ষণ করে। ৫। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক মজুরি বেশি হলেও প্রকৃত মজুরি সাধারণত কম হয়। পক্ষান্তরে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক মজুরি কম হলে প্রকৃত মজুরি অনেক বেশি হয় ।
৬। যে সমস্ত পেশায় শিক্ষা ব্যয় বেশি সে সমস্ত পেশায় আর্থিক মজুরি বেশি হলেও প্রকৃত মজুরি কম হয়। পক্ষান্তরে, যে সমস্ত পেশায় শিক্ষা ব্যয় কম সে সমস্ত পেশায় আর্থিক ব্যয় কম হলেও প্রকৃত ব্যয় বেশি হয়।
৭। যে সমস্ত কাজ সম্মানজনক, মর্যাদাকর ও ঝুঁকিহীন সে সমস্ত কাজে আর্থিক মজুরি কম হলেও প্রকৃত মজুরি বেশি হয়। পক্ষান্তরে, যে সমস্ত কাজ মর্যাদাহীন, ঝুঁকিবিহীন, পরিশ্রম সাপেক্ষ সে সমস্ত কাজে আর্থিক মজুরি বেশি হলেও প্রকৃত মজুরি কম হয়।