পঞ্চশীল কি কি?
জীব-জগতের দুঃখ এবং এ দুঃখ নিবৃত্তির পন্থা আবিষ্কারই ছিল- রাজপুত্র সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের পিছনে একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ছয় বৎসর কঠোর সাধনার পর তিনি আয়ত্ত করলেন সেই দুঃখ-মুক্তির অভ্রান্ত পথ। মানব জাতিকে শুধালেন সেই অমৃত পথের সন্ধান। সে মহান পথের প্রাথমিক পদক্ষেপ, স্বরূপ হচ্ছে পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতি। বুদ্ধের এ পঞ্চনীতি যদি সবাই মেনে চলে, তাহলে বর্তমান সমাজে বা রাষ্ট্রে যে অশান্তি বিরাজ করছে- সে অশান্তি কখনোই স্থায়ী হতে পারবেনা।
গৌতম বুদ্ধ প্রদত্ত পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতি গুলো হচ্ছে-
১. পাণাতিপাতা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
২. অদিন্নাদানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৩. কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৪. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
৫. সুরা মেরেয-মজ্জ পমাদটঠানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি।
পঞ্চশীলের বাংলা অনুবাদ
১. আমি প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
২. আমি অদত্ত বস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৩. আমি ব্যভিচার থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৪. আমি মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৫. আমি সুরা এবং মাদক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
পঞ্চশীল পালনের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি আনয়ন সম্ভব – উক্তির সত্যতা
শীল হচ্ছে সমস্ত কুশল কর্মের আদি ও রক্ষাকবচ। শীল পালন ব্যতীত নিজেকে কখনও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না এবং নৈতিক জীবন যাপন করাও সম্ভব নয়। পঞ্চশীলের প্রথম শীলটি প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। প্রাণী হত্যা করা মহাপাপ। প্রাণী হত্যা করলে জন্ম জন্মান্তরে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। প্রত্যেকে নিজের জীবনকে ভালোবাসে। তাই কোন প্রাণীকে আঘাত এবং হত্যা করা উচিত নয়। এই শীলটির দ্বারা কেবল প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা বোঝায় না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমস্ত প্রাণীর ক্ষতি সাধন হতে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এই শীলটি ছোট, বড়, হীন-উত্তম, দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য সকল প্রাণীকে রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
দ্বিতীয় শীলটি চুরি বা অদত্ত বস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। চুরি একটি সামাজিক অপরাধ ও বটে। চুরি করলে সাজা এবং দণ্ড ভোগ করতে হয়। সুনাম নষ্ট হয় এবং পরিবারে দুর্ভোগ নেমে আসে। তাই চুরি বা অদত্ত বস্তু গ্রহণ থেকে সকলের বিরত থাকা উচিত। এই শীলটি মানুষকে কেবল চুরি বা অদত্ত বস্তু গ্রহণ থেকে বিরত রাখেনা, অধিকন্তু সৎ উপায়ে নিজের পরিশ্রমে অর্জিত বস্তু বা অর্থের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে শিক্ষা দেয় এবং লোভহীন জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে।
তৃতীয় শীলটি কামাচার বা ব্যভিচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এই শীলটি মানুষকে অনৈতিক আচার-আচরণ পরিহার পূর্বক নৈতিক জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ হয়। এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কলহ থাকেনা। ফলে সংসার সুখের হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই শীলটি পালন করে সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করা।
চতুর্থ শীলটি মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। মিথ্যাবাদীকে সবাই ঘৃণা করে এবং বিশ্বাস করে না। যারা মিথ্যা কথা বলে তারা সর্বত্র নিন্দিত হয়। এই শীলটি মানুষকে কর্কশ, অপ্রিয় অশ্লীল, কটু, অসার কথা, পরনিন্দা করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। ফলে কায়, বাক্য ও মন পরিশুদ্ধ হয়।
পঞ্চম শীলটি সুরা এবং মাদক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। মাদকদব্র গ্রহণের ফলে মানুষের চিন্তা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বিবেক বুদ্ধি এবং হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। স্বাস্থ্য, সম্মান এবং ধন সম্পদ নষ্ট হয়। মাদক গ্রহণকারী নানা রকম পাপকর্মে লিপ্ত থেকে মানুষের ক্ষতি সাধন করে। এমনকি দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারায়। মাদক গ্রহণ কারীকে কেউ পছন্দ করে না। তারা ইহকালে যেমন কষ্ট পায়, তেমনি মৃত্যুর পর নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। মাদক দ্রব্যের মতো ধূমপান ও সাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই সকলের মাদকদ্রব্য গ্রহণ এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকা উচিত।
আরও পড়ুন: করনীয় মৈত্রী সূত্রটি কেন আবৃ্ত্তি করা হয়েছিল?
প্রাণী বা জীব হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা কথা বলা এবং মাদক দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকা- বুদ্ধের এই পঞ্চনীতি মানুষ যদি মেনে চলে, তাহলে বর্তমান সমাজে বা রাষ্ট্রে যে অশান্তি বিরাজ করছে তা দূর করা সম্ভব। মানুষে মানুষে হত্যা, রাহাজানি থেকে মানুষ যদি বিরত হয়, নারীর প্রতি ব্যভিচার বা নারী ধর্ষণ যদি সমাজে আদৌ না থাকে, মিথ্যা বাক্য বলা থেকে বিরত থেকে মানুষ যদি সত্যবাদী হয় এবং মাদকাসক্তি থেকে মানুষ যদি নিষ্কৃতি পায় তাহলে মানুষে মানুষে সৃষ্টি হবে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। যা মানব জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সমাজে চলে আসবে পরস্পরে সহিষ্ণুতা, সত্যবাদিতা, ন্যায় পরায়ণতা এবং সবচেয়ে মূল্যবান গুণ মানুষের নৈতিকতা। ফলে সমাজে বা রাষ্ট্রে কোনরূপ অশান্তি থাকতে পারবে না, প্রতিটি রাষ্ট্রের সহাবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে শান্তি, মহাশান্তি।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পঞ্চশীল পালনের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি আনয়ন সম্ভব।
উপসংহার
মানব জীবনে শীল অমূল্য সম্পদ। শীল পালনের মাধ্যমে মন শান্ত ও পবিত্র হয়। মন শান্ত হলে সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায়। শীল পালনের মাধ্যমে পরিবার তথা সমাজে যেমন শান্তি-শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, তেমনি পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং সদ্ভাবও সুদৃঢ় হয়। আর যারা নিজের জীবনকে মহৎ করে তুলেছেন, তারা সবাই শীল পালন করেছেন। তাই আমাদের সকলের শীল পালন করা উচিত।