Home » বড়ুয়া শব্দের অর্থ কি ? বাংলাদেশে বড়ুয়া জাতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।
বড়ুয়া শব্দের অর্থ কি বড়ুয়া জাতির ইতিহাস

বড়ুয়া শব্দের অর্থ কি ? বাংলাদেশে বড়ুয়া জাতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।

by TRI

প্রিয় পাঠকগণ, আজকে আমরা জানবো পালি বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বড়ুয়া শব্দের অর্থ কি ? এবং বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ তথা বড়ুয়া জাতির ইতিহাস সম্পর্কে। চলুন শুরু করি।

বৌদ্ধধর্ম সুপ্রাচীন ধর্ম। বৌদ্ধরা বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বাপেক্ষা উন্নত। ইতিহাসের অনিবার্য গতিশীলতায়  বৌদ্ধদের যে বিবর্তন, সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে যে চলমান কর্মকান্ড তারই প্রেক্ষাপটে বাঙালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রন্থখানি রচিত। গ্রন্থটি ২ ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের ইতিহাস অংশ ১৩ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এ ১৩ টি অধ্যায়ের মধ্যে ”বড়ুয়া” বৌদ্ধ সম্প্রদায় সম্পর্কে নবম অধ্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় উদ্ভব ও বড়ুয়া পদবী ব্যাবহার নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

বড়ুয়া শব্দের অর্থ

বড় – ধাতুর সাথে উয়া প্রত্যয় যোগে বড়ুয়া শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ, বড় + উয়া = বড়ুয়া। যার অর্থ বড় বা উৎকৃষ্ট। আভিধানিক অর্থ ব্রাহ্মণ যুবক, শ্রেষ্ঠ, মহান ,বিত্তবান ইত্যাদি। বড়ুয়া শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে বড় আর্য থেকে বউড়গ্যা বা বড়ুয়া শব্দটি এসেছে।

বৌদ্ধ সমাজে পুত্রবধুগণ শ্বশুরকে বউড়গ্যা এবং শ্বাশুরীকে আযোঁয়্যা সম্বোধন করত। বউড়গ্যা অর্থ আর্য এবং আযোঁয়্যা অর্থ আর্যমা শব্দের বিকৃত ব্যবহারিক শব্দ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বড়ুয়াকে বউড়গ্যা বলা হয়। অতএব,বড় আর্য>বউড়গ্যা>বড়ুয়া এভাবে উদ্ভব সম্ভব। আবার সেকালের পরিবার ও সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের বড়ুয়া সম্বোধন করা হত। এই বড়ুয়া শব্দটি কালক্রমে বড়ুয়া হয়েছে বলে কারো কারো ধারণা।

অন্য একটি মতে, বজ্জি বা বৃজি শব্দ হতে বড়ুয়া শব্দের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিশ্বকোষ অভিধানে বড়ুয়া সম্বন্ধে লিখিত আছে– একটি আখ্যায়িকা হতে জানা যায় বড়ুয়াগণ একটি প্রতিভাবান বৌদ্ধ রাজবংশের বংশধর।

আরও জানুন:   অনুপ্রাস বলতে কি বোঝ? অনুপ্রাস কত প্রকার ও কি কি?

বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ

দীর্ঘ আড়াই হাজারাধিক বছর পথ পরিক্রমায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির গতিধারায় যে বৈচিত্র লক্ষ করা যায় তা আর কোন ধর্মে দৃষ্ট হয়নি। দেশ, কাল, পরিবেশ, কৃষ্টি, সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্মের অবয়বে ভিন্নতা সূচিত হলেও মূল আদর্শ ও লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন।বাংলাদেশের বসবাসরত বৌদ্ধদের মধ্যে কয়েকটি জাতি গোষ্ঠী রয়েছে। তন্মধ্যে চাকমা, মারমা, রাখাইন,তঞ্চঙ্গ্যা,চাক প্রভৃতি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা,পটুয়াখালী,বরগনা,ও কক্সবাজার জেলায় বাস করে। বৃহত্তম চট্টগ্রাম নোয়াখালী, কুমিল্লা,লাকসা অঞ্চলে বসবাসরত বৌদ্ধরা সমতলী বৌদ্ধ এবং গেরাই বাঙালী বড়ুয়া বৌদ্ধ নামে পরিচিত।

বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। জনাব মাহবুব – উল আলম চট্টগ্রামের ইতিহাস পুস্তকে বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তী তুলে ধরেছেন, ভারতে বৌদ্ধ নির্যাতনের ফলে তাদের টিকিয়ে থাকা অসম্ভব হলে বৃজি বা বজ্জিকাপুত্ত উপজাতির এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র সাতশত অনুচরসহ মগধ হতে পলায়ন করে পঁগার পথে চট্টগ্রাম,কুমিল্লা,ও আধুনিক নোয়াখালীতে এসে উপস্থিত হন।(চট্টগ্রামের ইতিহাস,পুরানা আমল,পৃ.৩৯)। চন্ডীদাসের পদাবলী সাহিত্যে ঐ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। আবার বেণীমাধব বড়ুয়া,উমেশচন্দ্র মুৎসুদ্দী প্রমূখ মনীষীদের মতে, বৈশালীর বজ্জি বংশীয় বৌদ্ধগণ খি. পূর্বে চট্টগ্রামে এসে বসবাস করেন। বৃজি বা বজ্জি জাতি হতে বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি। মগধের অন্তর্গত বৈশালীর বৃজি জাতি সেখানকার অভিজাত রাজবংশের বংশধর। 

আরও পড়ুন:   অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন? বৌদ্ধধর্ম প্রচারে তার অবদান

বড়ুয়া বৌদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ

বড়ুয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে একটি জনশ্রুতি আছে তা হল ত্রয়োদশ শতকে  ‍তুর্কী আক্রমন শুরু হলে মগধের বৃজি গোত্রের বৌদ্ধরা পলায়ন করে আত্নরক্ষার জন্য পূর্বাঞ্চলের স্বধর্মীদের নিকট আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ক্রমশ দক্ষিণ পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে চট্টগ্রাম বিভাগে উপনিত হয়। চট্টগ্রাম তখন আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অধীন ছিল। এখানে আর ধর্মলোপের ভয় ছিল না। তারা ইতিপূর্বে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে মগধ থেকে আগত চন্দ্র সঙ্গীদের উত্তর পুরুষদের সাথে মিলিত হয়। পরবর্তীতে তারা বড়ুয়া বৌদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। 

বড়ুয়া পদবী ব্যবহারের সময়কাল

বড়ুয়া উপাধি কবে কখন প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। ত্রয়োদশ শতকে মগধের বৈশালী থেকে আগত চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণকারী বজ্জি বংশীয় লোকেরা নিজেদের নামের শেষে সম্ভ্রান্তসূচক বজ্জি পদবী ব্যবহার করত। কালক্রমে তারা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য বজ্জি পদবী ব্যবহার করত। পরবর্তীতে বজ্জি শব্দ থেকে বড়ৃয়া শব্দের উৎপত্তি। তবে পঞ্চদশ শতকের শেষে অথবা ষোড়শ শতকের শুরু থেকে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা বড়ুয়া পদবী ব্যবহার শুরু করে। বিশ শতকের প্রথমদিকে ত্রিপুরার বড়ুয়া পদবীধারী এক বিচারক চট্টগ্রামে আগমন করলে তার সাথে পরিচিত হবার পর বৌদ্ধদের মধ্যে বড়ুয়া উপাধি ধারণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

বড়ুয়ারা বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়।আজ তারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বড়ুয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, দিল্লী, মুম্বাই ও মায়ানমারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সামগ্রিক অগ্রগতিতে বড়ুয়া বৌদ্ধদের  অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বড়ুয়ারা আচরণে, কথাবার্তায় অত্যন্ত বিনয়ী ও সংযমী। এদিক থেকে তারা সার্থক বৌদ্ধ।

আরও পড়তে পারেন:   শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ইতিহাস

Related Posts