বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ সমূহের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিন্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার ফলে দেশের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের মূলে শুধু সেই দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতাই কাজ করেনা বরং এজন্য আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য শক্তির কালো হাত ও নেপথ্যে কাজ করে থাকে।
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই মাত্র তিন বৎসরের মাথায় সামরিক বাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে হটিয়ে রাষ্ট্র যন্ত্র দখল করে। উন্নয়নশীল দেশ সমূহের অন্যান্য রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশেও সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এবং সামরিক বাহিনী এদেশে কেমন ভূমিকা পালন করেছে তারও ইতিহাস রয়েছে। আলোচ্য অংশে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। তবে এ বিষয় আলোচনার পূর্বে তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
অধ্যাপক S. E. Finer তাঁর The Man on Horseback: The Role of the Military in Politics নামক গ্রন্থে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহনের কারন নির্দেশ করতে গিয়ে Disposition বা অভিপ্রায় এবং Opportunity বা সুযোগের মত দুই উপাদানের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
Myron Weiner এর মতে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ প্রধারণত তিনটি কারণে সাধারণত রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে থাকে। যথা:
১. সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মনে প্রদেশিক আনুগত্যবোধ নয় বরং জাতীয় আনুগত্যবোধ বিদ্যমান।
২. সামরিক বাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা সংরক্ষণের সাথে জড়িত।
৩. সামরিক বাহিনীর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি পরায়নতার কারনে তাহাদের প্রতি জনগণ আস্থাশীল। দেশকে আধুনিকীকরণে উৎসাহী সামরিক বাহিনী বর্তমান রাজনীতির সাথে জড়িত।
Prof. Decalo তার Coups and Army Rule in Africa নামক গ্রন্থে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানিক বা সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক স্বার্থ সংরক্ষণের প্রেক্ষিতেই উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখল করতে অনুপ্রাণিত করে।
Prof. Johnson উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিম্নবর্ণিত ৪ টি কারনে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে বলে উল্লেখ করেছেন-
ক. সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের উপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা।
খ. অপরাপর যেকোন বাহিনী হতে সামরিক বাহিনী অধিকতর সুসংগঠিত।
গ. অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত বলে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের অন্যান্য সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করে।
ঘ. দেশের অভ্যন্তরে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের উপরোক্ত বিষয়গুলো জড়িত থাকলেও আরো যে সকল বিষয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলো নিম্নরূপ:
১. রাজনৈতিক শূন্যতা
সত্যিকার অর্থে কোন দেশে শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল না থাকলে সে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণ করলেও কার্যত; কোন বিরোধী দল তখন তাদের কার্যকলাপ সুষ্ঠভাবে পালন করতে পারেনি। আওয়ামীলীগের শাসন আমলে মুসলিম লীগ সহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি করার অধিকার হারিয়ে ফেললে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি হয়। ফলে রাজনীতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও একদল শিথিলমনা রাজনৈতিক এবং ব্যক্তি বিশেষ একদল উচ্চাকাংখী সামরিক অফিসারের সাথে যোগ সাজস করে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আমন্ত্রণ জানায়, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হত্যা করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ
২. রাজনৈতিক অস্থিশীলতা
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বিকাশ লাভ করতে দেয়া হয়নি। দেশে আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা না করে শাসকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রচলিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার পরিবর্তে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। উক্ত বাহিনী দেশের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিপীড়নের ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনী রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে।
৩. সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাব
স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামীলীগ এর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং এর সুবাদে স্বাধীনতার পর তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে মনে করতে থাকে। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক দলাদলি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে। জনগণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধী দলের সমালোচনা তারা একেবারেই বরদাশও করতে পারেনি। যার ফলশ্রুতিতে বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে। সরকারের এমন অসহিষ্ণু মনোভাবের কারনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে।
৪. অর্থনৈতিক বিপর্যয়
অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যক্তি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অচল। ব্যক্তির জীবনে অর্থনৈতিক প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরে মানুষের কাংক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব হয়নি। মুদ্রাস্ফীতি কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের দুর্নীতির কারনে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। আওয়ামীলীগ এর আমলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যে অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল বি. এন. পির আমলেও সেই অবস্থা বিরাজ করছে।মূলত অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সুযোগে সামরিক বাহিনী ৭৫ এবং ৮২ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সামরিক শাসন জারি হওয়ার ফলে একদিকে যেমন দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অপরদিকে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রগতিশীলতাও এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক এ দুধরনের ভূমিকাই পালন করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা আলোচনা করতে হলে এই দুই বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে হবে। – (দেখুন- শেষ পর্ব)