সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক কি ?
রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের যে সম্পর্ক থাকে তাই সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক। বেসামরিক ও সামরিক সম্পর্কের বিষয়ে সনাতন ও আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানী, যুদ্ধ বিশারদগণ, ও রাষ্ট্রনায়কগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
জেনারেল ভন ক্লজ উইচ বলেন, “সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা ন্যায়সঙ্গত। সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হল যুদ্ধ করা আর যুদ্ধ হল নীতি বাস্তবায়নের একটি কৌশল।”
(গোলাম হোসেন সম্পাদিত, সরকার ও রাজনীতি, ১৯৯২, পৃ- ২৩৯)
মাওসেতুং সামরিক-বেসামরিক কৌশলকে দৃঢ়তার সাথে এভাবে বিশ্লেষণ করেন, “আমাদের নীতি হল এই যে, দল বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করবে এবং বন্দুক কখনোই পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে না”
(Talukder Moniruzzaman, Military Withdrawal from politics: A Comparative Study, 1988, Page:1)
বিগত শতাব্দীতে এবং বর্তমান শতাব্দীর প্রথমদিকে ফ্রান্সে দুটি নীতির ভিত্তিতে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নির্ণীত হত:
ক. সামরিক বাহিনীকে বৈধ বেসামরিক সরকারের পূর্ণ অধিনস্থকরণ ও
খ. সামরিক বাহিনী কখনই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না।
(ফিরোজা বেগম সরকারের সমস্যাবলী, ২০০১, পৃ-১৮১)
আরও পড়ুন: উন্নয়নশীল দেশের সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক আলোচনা কর
ফরাসি আইনবিদ M. Duguit বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের এ বিষয়টি চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, “রাজনৈতিক উত্থানপতনের সময় সেনাবাহিনী জাতীয় পতাকার পার্শ্বে এসে দাঁড়াবে এবং ক্ষমতাসীন যুদ্ধ মন্ত্রীর আদেশের জন্য অপেক্ষামান থাকবে। তারা সরকার নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে। রাজনৈতিক নিস্ক্রিয়তা সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান নৈতিক আদর্শ।”
[S.P. Huntington (ed), Changing Patterns of Military Politics, P-121]
সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের প্রকারভেদ
সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক সব দেশে একরকম নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান, সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রকৃতি ও আন্তর্জাতিক নির্ধারকের উপর সেনাবাহিনীর সাথে বেসামরিক সরকারের সম্পর্ক নির্ভর করে। Amos Perlmutter (পার্লমোটার) তাঁর “The Political Influence of the Military: A Comparative Reader” গ্রন্থে পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে সামরিক – বেসামরিক সম্পর্ককে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।
- Professional Civil – Military Relation.
- Revolutionary Civil – Military Relation.
- Praetorian Civil – Military Relation.
Professional Civil-Military Relation (পেশাদার সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক)
যে ধরনের সামরিক বাহিনী সরকারের কর্তৃত্ব মেনে নেয় অর্থাৎ নীতি নির্ধারনী দায়িত্ব বেসামরিক সরকারের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা অর্থাৎ যুদ্ধ কার্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে ধরনের সামরিক বাহিনীকে পেশাদারী সামরিক বাহিনী বলা হয়ে থাকে। যদি কোন দেশে এ ধরনের সেনাবাহিনী থাকে তবে সেসব দেশের সামরিক – বেসামরিক সম্পর্ক পেশাধারী সামরিক – বেসামরিক সম্পর্ক নামে পরিচিত। এ সম্পর্ককে Democratic Civil-Military relation ও বলা যায়। উন্নত দেশসমূহে এ ধরনের সামরিক – বেসামরিক সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, প্রভৃতি দেশে এ ধরনের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।
Revolutionary Civil-Military Relation (বিপ্লবী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক)
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর্মি সরকারের কোন আমলাতান্ত্রিক এজেন্ট নয়। আবার অনুন্নত রাষ্ট্রের ডিটোরিয়ান বাহিনীর মত রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপকারীও নয়। সকল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে এ বাহিনী গড়ে উঠে। পেশাদারী বাহিনীর মত এরা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় নয় বরং জীবন্ত ও সক্রিয়। তবে জনগণের সার্বিক আন্দোলনের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক মত এবং প্রচেষ্টা সমন্বিত থাকে। তাত্বিকভাবে বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর্মি বরং জনগণের আর্মি। আর সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে এ ধরনের সামরিক – বেসামরিক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। যেমন- চীনের Peoples China Revolutionary Army একটি বিপ্লবী সেনাবাহিনী।
Praetorian Civil-Military Relation (প্রিটোরিয়ান সামরিক বাহিনী)
যে সকল সামরিক বাহিনী বৈধ ক্ষমতাসীন বেসামরিক সরকারের নির্দেশ মেনে না নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি অভ্যন্তরীন নীতি নির্ধারনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে সেই সামরিক বাহিনীকে Praetorian Army বলে। বেসামরিক সরকারের সাথে তাদের সম্পর্ক Praetorian Civil-Military Relation নামে পরিচিত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সম্পর্ক দেখা যায়। যেমন– বাংলাদেশ, ব্রাজিল, পাকিস্তান, চিলি, হন্ডুরাস, নেপাল প্রভৃতি দেশে এই ধরনের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।