মূল্যবোধ কি?
‘মূল্যবোধ’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Values’। মূল্যবোধ সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিবিধানের সমষ্টি এবং সমাজের মানুষের মৌলিক বিশ্বাস, যা মানুষের নীতি ও চিন্তা-চেতনার মানদণ্ড। এটি মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে সহায়তা করে। মূল্যবোধের মাধ্যমে একটি জাতির চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সততা, ন্যায়বোধ ইত্যাদি পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি নিজ দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মূল্যবোধের সংজ্ঞা
মূল্যবোধের ধারণা ও সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছেন। নিচে মূল্যবোধের কতিপয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলো:
এইচ. ডি. স্টেইন এর মতে, “জনগণ যার সম্বন্ধে আগ্রহী, যা তারা কামনা করে, যাকে তারা অত্যাবশ্যক বলে মনে করে, যার প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা এবং যা করতে তারা আনন্দ পায় তাকে মূল্যবোধ বলে।”
এইচ. এম. জনসন এর মতে, “মূল্যবোধ সাধারণ মানদণ্ড এবং ইচ্ছশক্তির রীতিনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী এম. আর. উইলিয়াম এর মতে, “মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড, যার আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এ মানদণ্ডের দ্বারা সমাজে মানুষের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।”
আরও পড়ুন: আইন মান্য করার কারণ সমূহ লিখ
মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য
১। মূল্যবোধ নিয়মনীতির সমষ্টি
মূল্যবোধ সামাজিক রীতিনীতি, আদর্শ, নিয়মনীতি, ধ্যানধারণার সমষ্টি। এসব সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল মানবিক মতাদর্শ সমাজের মানুষকে দিকনির্দেশনা দান করে।
২। অলিখিত
এটি একটি অলিখিত সামাজিক বিধান। এটি এমন একটি বিধান, যা কোনো সমাজেই লিখিত থাকে না। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, আদর্শ ও মনোভাবের মধ্য দিয়ে মূল্যবোধের বিস্তার ঘটে।
৩। পরিবর্তনশীলতা
মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। এটি সমাজে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও শিক্ষার প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক পরিবর্তন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটায়। উদহরণ- অতীতে বাল্যবিবাহ স্বাভাবিক রীতি হিসেবে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে বাল্যবিবাহ নেতিবাচক মূল্যবোাধ হিসেবে পরিগণিত।
৪। নৈতিক প্রাধান্য
এটি আইন হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু সামাজিক ন্যায়নীতি ও নৈতিকতাবোধ থেকে উৎসারিত। মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
৫। আপেক্ষিকতা
সমাজ ও সংস্কৃতির পার্থক্যভেদে মূল্যবোধ ভিন্নতর হয়। মুসলিম দেশ ও অমুসলিম দেশের মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া একটি দেশের বিভিন্ন অংশেও মূল্যবোধের স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয়।
৬। অপরিমাপযোগ্য
এটি অপরিমাপযোগ্য এবং মানসিকতা থেকে উদ্ভূত। তাই একে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না; শুধু পর্যবক্ষণ করা যায়।
৭। সামাজিক মানদণ্ড
মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও ভালো-মন্দ কর্মকাণ্ডের বিচার করা যায়। এটি মানুষের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ করে।
৮। সামাজিক ঐক্য ও সেতুবন্ধ
এটি সমাজের মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলে। একই রকম রীতিনীতি ও আদর্শের অন্তর্ভুক্ত মানুষ পরস্পর মিলিত ও সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক ঐক্য ও সেতুবন্ধ রচনা করে।
৯। শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন
মূল্যবোধ মানুষ শিক্ষণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করে। কেননা এটি সহজাত নয়, বরং ধীরে ধীরে শিক্ষার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়।
১০। জাতির উন্নতির মাপকাঠি
মূল্যবোাধ যেকোনো জাতি ও সমাজের উন্নতির মাপকাঠি। দেখা যায়, যে সমাজে বা জাতির মূল্যবোধ যত বেশি উন্নত, সে সমাজ বা জাতি তত বেশি উন্নত ও প্রগতিশীল। তাছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।