কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ঋণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ। যে পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে ঋণের যোগান কাম্যস্তরে সীমাবদ্ধ রাখে তথা সব রকম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়, তাকে ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চার প্রকার পদ্ধতিতে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নিম্নে পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
ক) পরিমাণগত পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে ঋণের ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় না বরং সাধারণভাবে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে-
১। ব্যাংক হার পরিবর্তন
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির বিল বাট্টা করে দেয় এবং অনুমোদিত নিরাপত্তাসমূহের পরিবর্তে অগ্রিম বা ঋণ দেয়, সেই হারকে ব্যাংক হার বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক বাজারে সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এবং জনসাধারণ বেশি সুদের কারণে কম ঋণ গ্রহণ করে। আবার, ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার কমিয়ে দেয়। এতে জনগণ ও ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অধিক ঋণ গ্রহণ করে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যাবলি
২। খোলাবাজার নীতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বা প্রথম শ্রেণির সিকিউরিটি ক্রয়-বিক্রয় করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একে বলা হয় খোলাবাজার ব্যবসা।
ঋণের পরিমাণ কমাতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রি করে। তখন ঋণপত্র ক্রেতারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর চেক প্রদান করে। এর ফলে জনসাধারণের জন্য ঋণের পরিমাণ কমে যায়। আবার, ঋণের পরিমাণ বাড়াতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র ক্রয় করে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণপত্র বিক্রেতাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর চেক প্রদান করে। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো জনসাধারণের জন্য প্রদেয় ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারে।
৩। আমানত অনুপাতের তারতম্য নীতি
তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট চাহিদা আমানত ও মেয়াদি আমানতের একটি নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট জমা রাখতে হয়। সদস্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন অধিক হারে ঋণদান করতে থাকে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের অনুপাত বৃদ্ধি করে। আবার, যখন ঋণের সংকট দেখা দেয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্যতামূলকভাবে সঞ্চিতির অনুপাত কমিয়ে দেয়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের অনুপাত বৃদ্ধি বা হ্রাস করে ঋণদানের পরিমাণ কম বা বেশি করতে পারে।
খ) গুণগত পদ্ধতি
পরিমাণগত ঋণ পদ্ধতির পাশাপাশি সমান্তরালভাবে গুণগত পদ্ধতিও বিরাজমান। বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঋণ নিয়ন্ত্রণের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাকে গুণগত ঋণ নিয়ন্ত্রণ বলে। নিচে কয়েকটি গুণগত ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। ঋণের বরাদ্দকরণ নীতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত খাতে ঋণ দেওয়াকে ঋণের বরাদ্দকরণ নীতি বলে। ঋণের বরাদ্দ দু’ভাবে হতে পারে; প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের উপর একটি নির্দিষ্ট সীমা নিয়ন্ত্রণ করে দিতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ঐ নির্ধারিত ঋণের অতিরিক্ত ঋণ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন ও মোট সম্পত্তির উপর অথবা বিশেষ ধরনের সম্পত্তির উপর সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করতে পারে।
২। প্রত্যক্ষ শাস্তিমূলক পদ্ধতি
বাজারে ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে, তখন ঐ সব ব্যাংকের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
৩। নৈতিক প্ররোচনা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে ঋণ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিতকরণের জন্য নৈতিক উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে নৈতিক প্ররোচনানীতি বলে। ঋণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংককে ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নীতি অনুসরণের পরামর্শ দেয় ও অনুরোধ করে।
গ) বৈষম্যমূলক বা বাছাইমূলক ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
শুধু অত্যাবশ্যক খাতেই এ ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এ পদ্ধতিতে ঋণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিম্নরূপ-
১। অত্যাবশ্যকীয় খাতে ঋণদান
যে পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ খাত বাদ দিয়ে অত্যাবশ্যকীয় খাতে ঋণ মঞ্জুর করা হয়, তাকে অত্যাবশ্যকীয় খাতে ঋণ মঞ্জু বলে।
২। ভোগকারীদের ঋণ নিয়ন্ত্রণ
ভোগ্যপণ্য ক্রয়ের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে যে পদ্ধতিতে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাকে ভোগকারীর ঋণ নিয়ন্ত্রন বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের শর্ত কড়াকড়ি বা শিথিল করে ঋণের পরিমাণ কমাতে বা বাড়াতে পারে।
৩। জামানতি ঋণের প্রান্তিক হার নিয়ন্ত্রণ
যে পদ্ধতি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জামানতি ঋণের বা বন্ধকি ঋণের প্রান্তিক হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে জামানতি ঋণের প্রান্তিক হার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে।
ঘ) প্রচারণামূলক পদ্ধতি
১। পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম
বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, যেমন: রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বুলেটিন, প্রতিবেদনের সাহায্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক দেশের মুদ্রাস্ফীতি, ঋণনীতি, অর্থবাজারের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচার করে ঋণ নিয়ন্ত্রণের সদস্য ব্যাংকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়াকে প্রচারণা পদ্ধতি বলে।
২। সদস্য ব্যাংকসমূহের সহযোগিতা
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সদস্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাম্যভাব বজায় থাকলে ঋণ নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশেই সহজ হয়ে পড়ে।