সরকারি ব্যয়
সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ও এর আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে ব্যয় নির্বাহ করে, তাকে সরকারি ব্যয় বলে। সরকারি ব্যয় সাধারণত একটি আর্থিক বছরের সময়ে হিসাব করা হয়। একটি আর্থিক বছরে কোনো দেশের রাজস্ব ব্যয় ও মূলধনী ব্যয়, প্রত্যশিত ব্যয় ও অপ্রত্যাশিত ব্যয়, নির্ধারিত ব্যয় ও অনির্ধারিত ব্যয় ইত্যাদি ব্যয়ের সমষ্টিকে সরকারি ব্যয় বলে।
একসময়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না বলে সরকারি ব্যয়ও ছিল না। রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে সরকারি ব্যয় ধারণাটি প্রাধান্য পেতে থাকে। তবে ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে মতামত ব্যক্ত করেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা মনে করেন, সরকারের ভূমিকা অর্থনীতিতে সীমিত রাখা উচিত।
আরও পড়ুন: বিনিয়োগ কি? বিনিয়োগের প্রকারভেদ ও নির্ধারক সমূহ আলোচনা কর
সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ
বর্তমানে প্রতিটি দেশেই সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর উল্লেখযোগ্য কারণগুলো নিম্নরূপ:
১। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জনগণের মৌলিক চাহিদা। একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এগুলোর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারকে ক্রমশ অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
২। সম্পদের কাম্য ব্যবহার
কাম্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্পদের কাম্য ব্যবহার আবশ্যক। নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে অনাবিষ্কৃত সম্পদ আবিষ্কার, উত্তোলন ও তার কাম্য ব্যবহারে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৩। অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। এ লক্ষ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৪। প্রতিরক্ষা ব্যয়
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর বেতন-ভাতা, প্রশিক্ষণ বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হয়। আবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণে আধুনিক অস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৫। বিচার বিভাগ পরিচালনা
বিচার বিভাগ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। বিচার বিভাগ পরিচালনায় সরকারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৬। বেসরকারি প্রশাসন পরিচালনা
সরকারের বেসরকারি প্রশাসনের ব্যাপ্তি সারাদেশে বিস্তৃত। এ খাতে প্রতিবছর সরকারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৭। শিক্ষা
শিক্ষা সরকারি ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাতে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৮। কৃষি
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশই কৃষিনির্ভর। কৃষি এসব দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে এসব দেশে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৯। শিল্প
একটি দেশের দ্রুত উন্নয়নে শিল্পোন্নয়ন আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। শিল্পের উন্নয়নে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা, সদ্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পকে বিশেষ সহায়তা প্রদান, সরকারি উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
১০। সামাজিক নিরাপত্তা
কল্যাণরাষ্ট্র ধারণার উদ্ভবে বর্তমানে অধিকাংশ দেশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রচুর ব্যয় করে। পেনশন, গ্রাচুইটি, বৃত্তি, বয়স্ক ভাত, বিধবা ভাতা ইত্যাদির জন্য সরকার যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।
১১। পরিবেশ উন্নয়ন
প্রতিটি দেশের সরকার স্বাস্থ্যকর, মানসম্মত ও উন্নত আবাসস্থল নিশ্চিত করার জন্য পরিবেশের উন্নয়নে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।
১২। গবেষণা
উন্নত ও আধুনিক জীবনের জন্য প্রয়োজন আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি। গবেষণার মাধ্যমেই উন্নত ও আধুনিক জীবনের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ফলে সরকার গবেষণার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে।
১৩। দুর্যোগ মোকাবিলা
ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকান্ড, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
১৪। শিল্প ও সংস্কৃতি
প্রতিটি দেশের নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি রয়েছে। শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসারে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
১৫। অর্থনৈতিক উন্নয়ন
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হয়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
১৬। আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস
একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করে। এ বৈষম্য হ্রাসকল্পে সরকারকে ক্রমশ ব্যয় বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।