উত্তম শিল্প সম্পর্কের গুরুত্ব
কোন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণে উত্তম শিল্প সম্পর্কের বিকল্প নেই। উৎপাদনের উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। এসব উপাদানের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্রম তথা মানব সম্পদ। কারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কোন উৎপাদন কর্মমাণ্ড পরিচালিত হতে পারে না। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক বা মানব সম্পদই উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের কার্যকর ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান করে। তাই কোন উৎপাদনমুখী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়নে উত্তম শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো যেসব কারণে উত্তম শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের গুরুত্ব রয়েছে নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো-
১. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মানব সম্পদের উন্নত মনোবল ও কার্য সন্তুষ্টির উপর উৎপাদনশীলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠানে উত্তম শিল্প সম্পর্ক বজায় থাকলে শ্রমিকদের মনোবল উন্নত হয় এবং তারা কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। এতে শ্রমিকগণ পূর্বের তুলনায় অধিক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কার্যে মনোনিবেশ করে। ফলে তাদের উৎপাদিকা শক্তি ও দ্রব্যের উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
২. পারস্পরিক সহযোগিতা
প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আনয়নে উত্তম শিল্প সম্পর্কের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ শিল্প সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে শ্রম ব্যবস্থাপনার মধ্যকার মতবিরোধ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়। এতে শ্রমিকগণ হরতাল, ধর্মঘট, ঘেরাও লক আউট ইত্যাদি কর্মসূচি থেকে বিরত থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা বজায় থাকে এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৩. উন্নত কার্য পরিবেশ
প্রতিষ্ঠানে উন্নত কার্য পরিবেশ সৃষ্টিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ শিল্প সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। উত্তম শিল্প সম্পর্ক বজায় থাকলে কারখানায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্ভব হয়। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে একে অন্যের প্রতি বৈরিতার পরিবর্তে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে উঠে। এতে প্রতিষ্ঠানে উন্নত কার্য পরিবেশ গড়ে উঠে।
আরও পড়ুন: শিল্প সম্পর্ক কি? শিল্প সম্পর্কের উদ্দেশ্য আলোচনা কর।
৪. শিল্প বিরোধ হ্রাস
উত্তম শিল্প সম্পর্কের বিপরীত অবস্থাই হলো শিল্প বিরোধ। শ্রম-ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিভিন্ন কারণে যেমন- রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত কারণে শিল্প বিরোধ দেখা দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। কাজেই শিল্প শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হলে শিল্প বিরোধ ও শ্রম-ঘূর্ণায়মানতার হার অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়।
৫. মানসিকতার অনুকূল পরিবর্তন
সাধারণত শ্রমিকরা কায়িক-শ্রমের মাধ্যমে কাজ করে। এক্ষেত্রে তারা দৈনিক একটি নির্দিষ্ট শ্রম ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে উত্তম শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বজায় থাকলে শ্রমিকগণ প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করে। এমতাবস্থায় তাদের নিকট কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমার কোনো বালাই থাকে না, বরং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য তারা অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত কাজ রকতে আগ্রহী থাকে।
৬. উৎপাদন ব্যয় হ্রাস
উত্তম শিল্প সম্পর্ক উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে পারে। এক্ষেত্রে শ্রমিকগণ অধিক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কার্যে মনোনিবেশ করে। ফলে মোট উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এতে দ্রব্যের এককপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় ভোক্তাগণ কম দামে উন্নত মানসম্পন্ন পণ্য ক্রয় ও ভোগ করতে পারে।
৭. শিল্পীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
শিল্পে গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রয়োগ ও এর যথাযথ বাস্তবায়নে উত্তম শিল্প সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিষ্ঠানে উত্তম শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে উভয়পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয়। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮. অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়ন
উত্তম শিল্প সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কর্মীদের বেতন ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। পরিণামে শ্রমিক-মালিক ও সরকারের আর্থিক উন্নতি ঘটে। ভোগকারীরা সস্তায় উন্নতমানের পণ্য ও সেবা পায়, যা সামাজিক কল্যাণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক।
৯. প্রতিষ্ঠানের সুনাম
উত্তম শিল্প সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রতিষ্ঠানে শ্রম অসন্তোষ, নানা গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা থাকলে এর সুনাম বিনষ্ট হয়, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে।
১০. স্থায়িত্ব
উত্তম শিল্প সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি অর্জন ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধুর শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বিরাজমান থাকলে প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটে, যা প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির সহায়ক।
১১. ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা
উত্তম শ্রম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। দেশের সার্বিক শিল্পীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক অস্থিরতা রোধকল্পে সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১২. কার্য সন্তুষ্টি অর্জন
উত্তম শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের মনোবল ও কার্য সন্তুষ্টি আনয়ন করে। কার্য সন্তুষ্টি উৎপাদনের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে।