Home » ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বর্ণনা কর

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বর্ণনা কর

by TRI

‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ ফ্রান্সের এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির নাম। ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের পর ফ্রান্সে অস্বাভাবিক ও উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় বিপ্লবী ফ্রান্স আত্মরক্ষার প্রয়োজনে আধুনিক পৃথিবীর  ইতিহাসে সর্বপ্রথম দলীয় স্বৈরতন্ত্র বা Party Dictatorship এর মাধ্যমে এক নির্মম অত্যাচার শুরু করে। এই পরিস্থিতিকেই মূলত তৎকালীন ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব

১৭৯৩ সালের জুলাই মাসে জ্যাকোবিন দলের ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার জননিরাপত্তা সমিতির নেতৃত্বপদ গ্রহণ করলে প্রকৃত সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয়। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য অস্বাভাবিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল একথা অনস্বীকার্য। দেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ উদারতা দ্বারা প্রশমিত করা সম্ভব না হওয়ায় Law of Suspect এর প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক ধরপাকড় এবং বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে হাজার হাজার লোককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ শাসনকালে সন্ত্রাসের বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্বকালের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করা হলো-

১। ত্রাসের রাজত্ব

দেশের অভ্যন্তরীণ উচ্ছৃঙ্খলতাকে দমন করার উদ্দেশ্যে বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালকে নতুন করে সাজানো হয়। Law of Suspect নামক আইনের প্রয়োগ করে ব্যাপক ধরপাকড় এবং বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে থাকে। মূলত যে ব্যক্তিকেই বিপ্লবী আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হতো তার মৃত্যুদণ্ড ছিল অনিবার্য। অভিযুক্তের নিজের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের কোনো অবকাশ থাকত না। একমাত্র প্যারিস শহরের বিপ্লবী আদালতে ২৬৩৯ জন এবং ফ্রান্সের অন্যান্য অংশে ১৭ হাজার ব্যক্তির গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করা হয়। তাছাড়া আরও ৪০ হাজার লোককে দলবদ্ধভাবে হত্যা করা হয়। যার অধিকাংশই ছিল কৃষক ও শ্রমিক। রানি ম্যারি আতোয়ানেত এবং জিরন্ডিস্ট দলের ম্যাডাম রোলান্ডকেও গিলোটিনে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন:  ভিয়েনা সম্মেলন কী? ভিয়েনা সম্মেলনের মূলনীতিসমূহ আলোচনা কর

২। কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা

সন্ত্রাসের শাসনব্যবস্থার অধীনে কনভেনশনের সদস্যগণকে ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রদেশ, যুদ্ধক্ষেত্র প্রভৃতি স্থানে প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি লোকের আনুগত্য সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য সর্বদা উপস্থিত থাকতে হতো। এভাবে সমগ্র দেশের শাসনকার্য কেন্দ্র হতে পরিচালিত হতে থাকে।

৩। পরিস্থিতির চাপে উদ্ভূত অত্যাচার

সন্ত্রাসের শাসনব্যবস্থাকে পরিস্থিতির চাপে উদ্ভূত অত্যাচার বলে অভিহিত করা যায়। দেশের অভ্যন্তরে যখন বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে দানা বেধে উঠে তখন ফ্রান্স প্রায় সমগ্র ইউরোপীয় শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় একমাত্র স্বৈরাচারী কেন্দ্রীভূত শাসনের দ্বারাই দেশেকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল।

৪। প্রয়োজনীয়তা

সন্ত্রাসের শাসনব্যবস্থা যে এক অভূতপূর্ব শাসনব্যবস্থা ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এরূপ শাসনব্যবস্থা স্থাপন করা না হলে তখন ফ্রান্স বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হতো না। তবে এ শাসনব্যবস্থাকে কখনো রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক বলা যায় না।

৫। সন্ত্রাসের শাসনের কুফল

সন্ত্রাসের শাসনের কুফল কম ছিল না। এর ফলে নিছক সন্দেহের বশে বহু নিরপরাধ লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে। সন্ত্রাসের রাজত্ব কালে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লব সম্পর্কে এক ঘৃণার উদ্রেক করে। বিপ্লবের নামে অবাধ হত্যাযজ্ঞ ইউরোপের উদারপন্থিরাও সমর্থ করেনি।

৬। সন্ত্রাসের অর্থনৈতিক রূপ

সামরিক বাহিনীর সরবরাহ বজায় রাখা এবং মানুষের দুর্গতি কমানোর জন্য সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজন ছিল। ভোগ্যপণ্যের বণ্টনের দায়িত্ব ছিল কমিউনের। কমিউন রুটির জন্য রেশন কার্ড প্রবর্তন করে। সেকশনের কমিশনাররা মজুদদারের বাড়ি তল্লাশি করতে পারত। সর্বোচ্চ মূল্য সংক্রান্ত আইনও সন্ত্রাসের আতঙ্কে কার্যকর হয়। সন্ত্রাসের দাপটে অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ জননিরাপত্তা কমিটির হাতে চলে আসে।

৭। অন্তর্দ্বন্দ্ব

সন্ত্রাসের শাসন পরিচালকদের মধ্যে ডানটন (Danton) ও রোবস্পিয়ার (Robespierre) ছিলেন প্রধান। কিন্তু এ দু’নেতার মত ও আদর্শ ছিল ভিন্ন। ডানটন ছিলেন অপেক্ষাকৃত নরমপন্থি ও মানবদরদি। অন্যদিকে রোবস্পিয়ার ছিলেন ‍নিষ্ঠুর ও নির্মমতার চরমরূপ। সন্ত্রাসের শাসনব্যবস্থা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অত্যাচারী হয়ে উঠছে দেখে ডানটন এর উগ্রতা হ্রাস করার প্রস্তাব করেন। তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা স্থাপন করার জন্য জননিরাপত্তা সমিতিকে জনদরদি সমিতিতে রূপান্তর করার পরামর্শ দান করেন। এবং গিলোটিনে মানুষের প্রাণনাশের বিরোধিতা করেন। এতে রোবস্পিয়ারের সাথে তার মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং রোবস্পিয়ার ডানটনকে প্রণদণ্ডে দণ্ডিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন।

৮। রোবস্পিয়ারের উত্থান

ডানটন, ডেসমোলিনস্ এবং আরো অনেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর তাদেরকে বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করা হয়। এভাবে রোপস্পিয়ারের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়ে উঠে এবং তার স্বৈরাচারী ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। ১৩ই এপ্রিল ১৭৯৪ ডানটনপন্থিদের বিনাশ সম্পূর্ণ হওয়া থেকে শুরু করে ২৭ শে জুলাই পর্যন্ত রোবস্পিয়ার এক ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। এমনকি তিনি প্রচলিত খ্রিস্টধর্মকে বাদ দিয়ে একটি নতুন ধর্মমত প্রচলেন চেষ্টা করেন।

৯। মহাসন্ত্রাস

রোবস্পিয়ার নিজের ক্ষমতাকে সীমাহীন করার উদ্দেশ্য ১০ই জুন ১৭৯৪ এক আইন জারি করে বিপ্লবী বিচার ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন। এ আইনে রাজতন্ত্রের সমর্থন, প্রজাতন্ত্রের কুৎসা, ব্যভিচার, মিথ্যা সংবাদ প্রচার, কোনো সরকারি সম্পত্তি চুরি, অর্থ তছরূপ ইত্যাদি যেকোনো অপরাধের জন্য প্রাণদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবীর সাহায্য নিতে পারবে কিনা তাও স্থির করার ক্ষমতা বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে হাতে ন্যস্ত করা হয়। অর্থাৎ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যাকেই বিপ্লবী আদালতে বিচারের জন্য আনা হবে, তারই প্রাণদণ্ড অনিবার্য। এ নীতিকে ‘মহাসন্ত্রাস’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।

১০। রোবস্পিয়ারের পতন ও সন্ত্রাসের শাসনের অবসান

রোবস্পিয়ারের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরপর কয়েকটি যুদ্ধে ফরাসি সৈন্যদের সাফল্যের পর যুদ্ধের গতি ফ্রান্সের অনুকূলে আসলে জনসাধারণ সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে। কারণ বহিরাক্রমণের ভীতি সৃষ্টি করেই সন্ত্রাসের অত্যাচারী শাসন চালানো হচ্ছিল। অন্যদিকে নিরাপত্তা কমিটির মধ্যে বিরোধ ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠে। রোবস্পিয়ার যখন আরো কয়েকজনকে গিলোটিনে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থৎ ফাউক, ট্যালিয়ে ফ্রেরোঁ তারাও রোবস্পিয়ারকে গিলোটিনে হত্যা করার মাধ্যমে নিজেদের প্রাণ রক্ষার একমাত্র পথ দেখতে পেলেন। ফলে ২৬ জুলাই ১৭৯৪ কনভেনশনের সভায় রোবস্পিয়ারের বিরুদ্ধে ডানটনকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় এবং ২৭ জুলাই কনভেনেশন রোবস্পিয়ার ও তার দুই সহকারী সেন্টজাস্ট ও কোথো এবং আরো কয়েকজনকে গিলোটিনে প্রাণদণ্ডের আদেশ করে। ২৮ জুলাই ১৭৯৪ কনভেনশনের নির্দেশমতো রোবস্পিয়ার ও তার অনুচরবৃন্দকে যথারীতি গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করা হয়। রোবস্পিয়ারের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে।

Related Posts

2 comments

Arjue ashik September 21, 2022 - 11:30 pm

পেজটা আরেকটু বড় করার অনুরোধ রইলো যাতে করে কেউ কোন প্রশ্ন সার্চ করলে খুজে পেতে ব্যর্থ না হয়

TRI September 22, 2022 - 2:34 pm

ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য।

Comments are closed.