আইন সমাজের দর্শনস্বরূপ। সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা আইনের প্রভাব লক্ষ্য করি। খেলার মাঠে, ক্লাব ঘরে, সিনেমা হলে, স্কুলে বা কলেজে, মসজিদে, মন্দিরে সব জায়গায় যে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেই চলতে হয়, তাকে আইন বলা হয়। আইনের যথার্থ স্বরূপ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং ভাব ও নীতির উপর নির্ভরশীল।
আইনের সংজ্ঞা
এরিস্টটলের মতে, “পক্ষপাতহীন যুক্তিই হচ্ছে আইন।” (Law is the passionless reason.)
জন অস্টিনের মতে, “আইন কোন উর্ধ্বতন কর্তৃক অধস্তনকে প্রদত্ত আদেশ বিশেষ।”
অধ্যাপক গ্যাটেল এর মতে, “রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম-কানুন তৈরী করে, অনুমোদন দেয় এবং বলবৎ করে সেগুলোকেই আইনবলা হয়।”
হব্স এর মতে, “জনগণের ভবিষ্যত কার্যাবলি নির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যে নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাই দেশের আইন।”
আইনের উৎস
আইনের বেশ কয়েকটি উৎস রয়েছে। । নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো-
১। চিরাচরিত প্রথা
সব দেশের আইন ব্যবস্থার একটা বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে প্রথা। আর প্রাচীন যুগে প্রথাই ছিল তৎকালীন বিধি-নিষেধের প্রধান উৎস। অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে, “কোন এক সময়ে কোন ব্যক্তি কোন উদ্দেশ্য বা আকস্মিকভাবে বিশেষ রীতিনীতি সমাজে প্রবর্তন করে এবং কাল ক্রমে অন্য সকলে তা মেনে চলে। এভাবেই প্রথার উদ্ভব হয়।” যেমন- ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন। ভারতের হিন্দু-মুসলিম আইন।
২। ধর্ম
প্রাচীন কালে ধর্ম ও আইন এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল যে, অনেক সময় কোনটি আইন, কোনটি ধর্মীয় অনুশাসন তা সুস্পষ্ট ভাবে আঁচ করা যেত না। উড্রো উইলসন বলেন যে, “আদিতে রোমান আইন কতিপয় ধর্মীয় সূত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না।” বর্তমান কালে হিন্দু ও মুসলিম আইনেও ধর্মের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
৩। বিচারকের রায়
সর্বোচ্চ আদালতের বিচার-মীমাংসা অনেক সময় আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিচারপতি হোসস্ বলেন, “বিচারকগণ আইন প্রণয়ন করেন। এবং এটা তাদের এক আবশ্যিক কর্তব্য।” জনৈক আমেরিকান বিচারপতি বলেন, “বিচারপতিগণ অবশ্যই আইনপ্রণয়ন করেন এবং চিরকালই করে যাবেন।” অধ্যাপক গেটেল বলেন, “আইন প্রণেতা হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি, রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল প্রথার ব্যাখ্যা কর্তা ও প্রয়োগকারী হিসেবে।”
৪। আইনজ্ঞগণের ভাষ্য
বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, পর্যালোচনাও আইনের অপর একটি উৎস। তারা প্রাচীন ও বর্তমান তথ্যাদির তুলনামূলক আলোচনা করে আইনের ব্যাখ্যা ও স্বরূপ তুলে ধরেন। যেমন- ইমাম আবু হানিফা, ইংল্যান্ডের ব্রাকস্টোন, আমেরিকার স্টোরী, কেন্ট প্রমূখ আইনজ্ঞ অন্যতম।
৫। ন্যায়নীতি
সর্বকালে এবং সর্বদেশে ন্যায়নীতি আইনের বিরাট উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। অধ্যাপক গিলিক্রাইস্টের মতে, “ন্যায়নীতির অর্থ সাম্য বা ন্যায়বিচার অথবা যেখানে আইনের বিধান ঠিকমত প্রযোজ্য হয় না সেখানে সাধারণ বুদ্ধি বা ন্যায়বোধের উপর ভিত্তি করে বিচার করা।” প্রাচীন কালে রোমের গ্রীটার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নতুন আইনের প্রবর্তন করতেন।
৬। আইন পরিষদ
আধুনিক কালে আইনপরিষদ আইনের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান উৎস বলে পরিগণিত হয়। ওপেন হ্যাইম জনমতকেই আইনের একমাত্র উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। আইনসভাই জনমত, প্রথাগত বিধি-বিধান, ন্যায়নীতি প্রভৃতিকে আনুষ্ঠনিকভাবে আইনের রূপদান করে থাকে।
আরও পড়ুন: সাইবার অপরাধ কি? সাইবার অপরাধের ধরন ও বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ আইন
৭। সংবিধান
সংবিধান আইনের একটি আনুষ্ঠানিক উৎস বলে স্বীকৃত। সংবিধানেই রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন এবং বিধি বিধান লিখিতভাবে বিদ্যমান থাকে। আর সংবিধানের আইনের সাথে মিল রেখে আইনসভা আইন তৈরি করে। আর এ আইনকে বাস্তবে প্রয়োগকালে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ আরো আইনের জন্ম দেয়।
৮। আন্তর্জাতিক আইন
আন্তর্জাতিক আইনকেও বর্তমান সময়ে আইনের উৎস বলে চিহ্নিত করা হয়। তার কারণ, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৯। জনমত
আইনের উৎস হিসেবে জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো তাদের অন্যতম দায়িত্ব। আইনসভায় যে কোন আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়।
১০। নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী
আধুনিককালে শাসন ব্যবস্থায় জটিলতার কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্ব নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের নিকট অর্পণ করে। এরূপ ক্ষমতা বলে জারীকৃত ঘোষণা ও আদেশ গুলোকে ডিক্রীআইন বা প্রশাসনিক আইনও বলে।