অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কি?
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হলো একটি নির্দিষ্ট বাৎসরিক হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং সে অনুপাতে জাতীয় সম্পদের বিনিয়োগ।
অন্য কথায় বলা যায়, অনুন্নত দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাই হলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে বেকার সমস্যা সমাধান করা যায়। এতে দেশ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সংজ্ঞা
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ L. Robbins এর মতে, “To plan is to act with a purpose to choose and choice is the essence of economic activity.” অর্থাৎ, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কার্যাবলি সম্পাদন করার জন্য উদ্দেশ্য পছন্দ করাকে পরিকল্পনা বলে।
অর্থনীতিবিদ Dickenson এর মতে, “Economic planning is the making a major economic decision what and how much is to be produced and to whom it is be allocated by the conscious decisions of a determinate authority on the basis of comprehensive survey of the economic system as a whole.”
অর্থাৎ, “কোন দ্রব্য, কি পরিমাণ উৎপাদন এবং কিভাবে বণ্টন করা হবে, সে ব্যাপারে সমগ্র অর্থনীতির ব্যাপক জরিপের ভিত্তিতে কোন নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিশেষ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তাকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।”
অর্থনীতিবিদ ডারবিনের মতে, “নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যাবলি পছন্দ ও বাছাই করে কার্যাবলি সম্পাদন করাকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।”
অতএব, উপরোল্লিখিত আলোচনা ও সংজ্ঞাসমূহ থেকে বলা যায়, দেশে প্রাপ্ত সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহাররের মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যে সুচিন্তিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় তাকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।
আরও পড়ুন: প্রকল্পের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
উন্নয়নশীল দেশে প্রযোজনের তুলনায় সম্পদ সীমিত বলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট সময়ে কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অপরিহার্য।
নিম্নে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো-
১) দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা যায়। ফলে সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। যেমন- চীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সাহায্যে অল্প সমযের মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
২) জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন
উন্নয়নশীল দেশসমূহে জনসাধারণের মাথাপিছু ও জাতীয় আয় অত্যন্ত কম বলে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নীচু। কিন্তু জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। তাই জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়।
৩) সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার
পরিকল্পনাহীন সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের কোন নিশ্চয়তা থাকে না বলে সম্পদের অপচয় ঘটে। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। পরিকল্পিত অর্থনীতিতে দেশীয় সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
৪) আয় বৈষম্য দূরীকরণ
পরিকল্পনাহীন সমাজ ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ গচ্ছিত থাকে। সমাজের বৃহত্তম অংশ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়। মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বাড়তে থাকে। কিন্তু সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ন্যায়সঙ্গতভাবে দেশের সম্পদ বণ্টন করা হয়। ফলে আয় বৈষম্য দূর হয়।
৫) বেকার সমস্যার সমাধান
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেকার সমস্যা প্রকট থাকে। কেইনসের মতে, “বিনিয়োগের স্বল্পতাই বেকারত্বের কারণ।” অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে সুষম বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে বেকার সমস্যা দূর করা যায়। সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সুষম বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। ফলে দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা যায়।
৬) খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে খাদ্য বৃদ্ধি না পাওয়ায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে এ সমস্যা দূর করা যায়। সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়।
৭) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন
পরিকল্পনাহীন অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত সুনামার্জনের জন্য প্রত্যেক উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে থাকে বলে কখনও কম উৎপাদন আবার কখনও উৎপাদনের উদ্বৃত্ত দেখা দেয়। ফলে বাজার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পরিকল্পিত অর্থনীতিতে কর্তৃপক্ষ সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে। এতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
৮) একচেটিয়া কারবার রোধ
পরিকল্পিত অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীগণ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে না বরং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। এতে একচেটিয়া কারবারের অবসান ঘটে এবং দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
৯) জাতীয় সম্পদের অপচয় হ্রাস
অপরিকল্পিত অর্থনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে। ফলে সামাজিক অপচয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা দেশকে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতার অভিশাপ হতে রক্ষা করতে পারে। এতে প্রতিযোগিতাজনিত অপচয় হ্রাস পায়।
১০) বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস
সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কোন দেশ জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। ফলে বিদেশ হতে খাদ্যসহ সকল প্রকার দ্রব্য সামগ্রী আমদানী করতে দেশকে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে খাদ্যসহ অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করা যায়। ফলে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
১১) মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস
মুদ্রাস্ফীতি দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাময়িক সহায়তা করলেও দীর্ঘকালীন মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে এবং ধন-বৈষম্য হ্রাস পেয়ে দেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করবে।
পরিশেষে বলা যায়, উপরোল্লিখিত কর্মসূচীসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সুনিশ্চিত করার জন্য উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা একান্ত অপরিহার্য।