চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলতে এমন স্বার্থগোষ্ঠী বা দলকে বুঝায় যারা সরকারকে নীতি প্রণয়নে চাপ প্রয়োগ করে সরকারি নীতি নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করে। আবার যেহেতু এসব গোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থের জন্য কাজ করে বলে এদেরকে সুবিধা আদায়কারী বা স্বার্থকামী গোষ্ঠীও বলা হয়।
অর্থাৎ, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলতে সে সমস্ত সংগঠিত গোষ্ঠীকেই বুঝায়, যারা সরকারি কাঠামোর বাইরে থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোনয়ন ও নিয়োগ, সরকারি নীতি গ্রহণ, পরিচালনা ও নির্ধারণে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। উদাহরণ- ছাত্র সংসদ, শ্রমিক সংঘ ইত্যাদি।
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উদ্ভবের ইতিহাস
রাজনৈতিক মঞ্চে গোষ্ঠী মতবাদ দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। এই মতবাদের প্রথম প্রবক্তা হলেন আর্থার এফ. বেন্টলী, ১৯০৮ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ “The Process of Government” – এ এই মতবাদ প্রচার করেন। পরবর্তীতে চার্লস হেগেন এবং রোল্যান্ড ইয়ং এ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রকারভেদ
বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Almond and Powell স্বার্থগোষ্ঠীকে মোট চার ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১) স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থ গোষ্ঠী
২) সংগঠনভিত্তিক স্বার্থ গোষ্ঠী
৩) সংগঠনহী স্বার্থ গোষ্ঠী
৪) প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গোষ্ঠী
স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থ গোষ্ঠী
কোন বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে কোন নেতার আবির্ভাবের ফলে যে গোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের অভিযোগ ও অসন্তোষকে ব্যক্ত করে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা, আন্দোলন এমনকি গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক তথা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থ গোষ্ঠী বলে।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক দল ও স্বার্থ গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য
সংগঠনভিত্তিক স্বার্থ গোষ্ঠী
যে স্বার্থ গোষ্ঠী নির্দিষ্ট সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি দাওয়া পেশ করে থাকে তাদেরকে সংগঠন ভিত্তিক স্বার্থ গোষ্ঠী বলে। যেমন- শ্রমিক সংঘ, শিল্পপতিদের সংগঠন ইত্যাদি।
সংগঠনহীন স্বার্থ গোষ্ঠী
সংগঠনহীন স্বার্থ গোষ্ঠী বলতে জাতিগত, বংশগত, ভাষাগত প্রভৃতি স্বার্থ গোষ্ঠীকে বুঝায়। এদের নির্দিষ্ট কোন সংগঠন থাকে না বলে এদেরকে সংগঠনহীন স্বার্থ গোষ্ঠী বলে।
প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গোষ্ঠী
কোন পেশায় চাকুরিরত লোকদের নিয়ে যে স্বার্থ গোষ্ঠী গঠিত তাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ গোষ্ঠী বলে। যেমন- বার সমিতি।
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন কলা কৌশলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। যে সকল কাজের মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠী বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে তা নিম্নরূপ-
বৃহত্তর সমাজ গঠন
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আকারে ক্ষুদ্র। এদের দ্বারা সংকীর্ণ স্বার্থ প্রতিফলিত হয়। কিন্তু যখন কোন জাতীয় স্বার্থ নিয়ে সরকারকে কোন চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী চাপ দেয় তখন বৃহত্তর জনসমাজ তাদেরকে সমর্থন দেয়। এভাবে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বৃহত্তর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
নির্বাচন প্রচারণায় প্রভাব সৃষ্টি
নির্বাচন হওয়ার পূর্বে নির্বাচনী প্রচারণায় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে। তারা স্বার্থের পিছনে ছুটাছুটি করে। যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে দলের পক্ষে তারা পরোক্ষভাবে প্রচারণা চালায়। যাতে করে সরকার গঠনের পর তারা তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারে।
সরকারের প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারের প্রিয় হয়ে থাকার চেষ্টা করে। তারা নির্বাচনে গোপনে যে দলের পক্ষে প্রচারণা চালায় সে দল নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলে, যে দল সরকার গঠন করে, সে সরকারের প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন জানায় যাতে তাদের স্বার্থ আদায় হয়।
আইন ও শাসন বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কোন আইন প্রণয়নের সময় আইন বিভাগকে প্রভাবিত করে থাকে। যে সকল কমিটি আইন প্রণয়নে ভূমিকার রাখে সে সকল কমিটিকে প্রভাবিত করে। আবার শাসন বিভাগকেও নীতি বাস্তবায়নের সময় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভাবিত করে থাকে।
বিচার বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি
চাপ সৃষ্টিকারী দল বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করে থাকে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যথা- নিয়োগ, চাকরির নিশ্চয়তা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধাদি প্রদান। এ তিনটির মধ্যে নিয়োগের বেলায় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বার কাউন্সিলের যে ব্যক্তি তাদের অনুগত থাকবে সে ব্যক্তিকে বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তারা শাসন বিভাগকে চাপ দিয়ে থাকে। আবার বিচারকদের রায়েও তারা প্রভাব বিস্তার করে।
আমলাদের উপর প্রভাব বিস্তার
দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমলারা। তারা যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে থাকে। আমলাদের সাথে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর যোগাযোগ বেশ ভাল। প্রায় সব কাজে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আমলাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
জনমত গঠন
জনমত গঠন করে স্বার্থকামী গোষ্ঠী সরকারের উপর চাপ দিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করে। বিভিন্ন প্রকার নীতি ও আদর্শের কথা প্রচার করে তারা জনসাধারণের সমর্থন আদায় করে নেয়। আর সরকারকে জনসমর্থন দেখিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেয়।
রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ
রাজনৈতিক দলের উপর স্বার্থকামী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সদস্যবৃন্দ রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের অনুকূলে নীতি ও আদর্শ প্রণয়ন করতে চাপ দেয়। নির্বাচনের সময় দলকে বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদান করা হয়। ফলে নির্বাচন শেষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দল তাদের স্বার্থে কাজ করতে বাধ্য থাকে।
বিক্ষোভ প্রদর্শন
অনেক সময় নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্বার্থকামী দল বিক্ষোভ প্রদর্শন বা হিংসাত্মক ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সরকারকে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এ ধরণের গোষ্ঠীর সংগঠন সাধারণত খুব শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশের ‘পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন’ – কে এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সংযুক্ত করা যেতে পারে।