Home » চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা,

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর

by TRI

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মৌর্য বংশের রাজত্বকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার বিবরণ পাওয়া যায় মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অশোকের শিলালিপি ও অন্যান্য উপাদান থেকে। পরবর্তীকালে জুনাগড় শিলালিপি, বিদ্যবদন, মুদ্রারাক্ষস ও জৈন ‘পরিশিষ্টপাবন’ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও অনেকে বলেছেন, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের পথ ধরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। অশোকের শিলালিপিতে মৌর্য বংশের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে যে প্রামাণ্য চিত্র পাওয়া যায় তা অধিকাংশই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলের বলে ধারণা করা হয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক স্থাপিত বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা প্রধানত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক এই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

১) কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা রাজা, মন্ত্রী, অমাত্য ও মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে গঠিত ছিল।

রাজা: শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্থানে থাকতেন রাজা। মৌর্য রাজারা ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী না হলেও নিজেদেরকে ‘দেবতাপ্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত করতেন। রাজা ছিলেন একাধারে সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহক, প্রধান বিচারপতি, প্রধান সেনাপতি ও প্রধান আইন-প্রণেতা। রাজ কর্তব্য সম্পর্কে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে। মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুসারে, রাজা সকল সময় রাজ দরবারে উপস্থিত থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। মেগাস্থিনিস এও বলেছেন যে, রাজা ব্যক্তিগত শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য দিবানিদ্রা ও ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতেন। রাজা স্বয়ং রাজসভায় উপস্থিত থেকে প্রজাদের অনুযোগ শুনতেন আর কৌটিল্যের নীতি অনুসরণ কর বিচারপ্রার্থীকে অধিক সময় অপেক্ষমান রাখতেন না । এ ক্ষেত্রে রাজা প্রজাহিতৈষী ছিলেন।

মন্ত্রী: কৌটিল্যের মতে, সার্বভৌম রাজশক্তি কোন এক ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত কর্মচারীর সহায়তা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মাধ্যমে মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রী ও অমাত্য নামে দুই শ্রেণীর মন্ত্রীর কথা জানা যায়। মেগাস্থিনিস এদের ‘সচিব’ ও ‘অমাত্য’ বলে বর্ণনা করেছেন। রাজ্যের প্রধান অমাত্যরা মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হতেন। তবে যাদের মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অর্থ লোভ থাকত না তারাই বেশি নিয়োগ পেতেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে মন্ত্রীদের বাৎসরিক বেতন ছিল ৪৮,০০০ পান। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সকল কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন। তবে মন্ত্রীদের সংখ্যা তখন নির্দিষ্ট ছিল না। 

মন্ত্রী পরিষদ: মন্ত্রী ছাড়াও তখনকার সময়ে মন্ত্রী পরিষদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যাদের স্থান নির্দিষ্ট মন্ত্রীদের পরে ছিল। এ পরিষদের তেমন কোন কাজ ছিল না। তবে রাজ্যের গুরতর অবস্থার সময় আলোচনার জন্য মন্ত্রীপরিষদ বসত। যখন কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতের আগমন হত তখন তাদের অভ্যর্থনা করার সময় রাজসভায় মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা উপস্থিত থাকতেন। মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের বাৎসরিক বেতন ছিল ১২,০০০ পান। অশোকের অনুশাসনলিপিতেও মন্ত্রীপরিষদের উল্লেখ আছে।

অমাত্য ও অন্যান্য কর্মচারী: মন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ ছাড়াও ‘অমাত্য’ নামক এক শ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা শাসন ও বিচার কার্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতেন। মন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ ও অমাত্য বাদেও অনেক দায়িত্বশীল কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রীক লেখকদের বর্ণনা অনুসারে এরা ম্যাজিস্ট্রেট নামে পরিচিত ছিলেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এইরুপ ৩২ জন অধ্যক্ষের উল্লেখ আছে। গ্রামাঞ্চল ও নগরের শাসন বিভাগের বিভিন্ন শাখা ভিন্ন ভিন্ন অধ্যক্ষের পরিচালনাধীন থাকত। মেগাস্থিনিসের বর্ণা অনুযায়ী অধ্যক্ষদের মধ্যে কেউ কেউ সামরিক বিভাগের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট থাকতেন।

সামরিক সংগঠন: মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে চন্দ্রগুপ্তের সামরিক বাহিনীর সম্বন্ধে বিবরণ পাওয়া যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনী ছিল সুশিক্ষত ও সুসজ্জিত। ৬,০০,০০০ পদাতিক, ৩০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী ও ৯,০০০ হাতি নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামরিক বাহিনী গঠিত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ত্রিশ সদস্যের উপর সামরিক বাহিনীর বিভাগ পরিচালনা করা হত বলে উল্লেখ আছে। স্মিথ ও প্লুটার্ক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামরিক বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

আরও পড়ুন
কুটিকা কি? কুটিকা কবিতার দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা কর।
জটা শব্দের অর্থ কি? এ কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা কর।

অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, তখনকার সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হত। তীর-ধনুক, বর্শা, কুঠার ও তরবারি ছিল প্রধান যুদ্ধাস্ত্র। এছাড়া অর্থশাস্ত্রে ‘স্থিতযন্ত্র ও চলযন্ত্র’ দু-প্রকার যান্ত্রিক অস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

মৌর্য সম্রাটদের একটি নৌ-বাহিনীরও সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। নৌ-বাহিনীর সেনাপতিকে ‘নাব্যধ্যক্ষ’ বলা হত। এইচ.সি. এর মতে মৌর্যদের নৌ-বাহিনী জলদস্যু দমনে নিযুক্ত থাকত। স্মিথের মতে, নৌ-বাহিনীর মাধ্যমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মিশর, সিরিয়াসহ প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। অশোকের রাজত্বকালে নৌ-বাহিনীর শক্তি ও দক্ষতা অক্ষুণ্ণ ছিল। 

পৌর শাসন: মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মৌর্য রাজধানী পাটলিপুত্রে পৌর শাসনভার ত্রিশজন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের ওপর ন্যস্ত ছিল। পাঁচজন সদস্য নিয়ে ছয়টি ভাগে এই বিভাগ বিভক্ত ছিল। এই সকল বিভাগগুলো নিজ দায়িত্ব ছাড়াও বাজার, বন্দর, মন্দিরাদির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন। তখনকার পৌর শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিককালের পুলিশ-রাষ্ট্রের তুলনা করা যায়।

রাজস্ব: খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় অব্দের মধ্যে উত্তর-ভারতে অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। সরকারের প্রধান আয় হিসেবে ভূমি রাজস্ব গুরুত্ব লাভ করে। কৌটিল্য রাজস্ব ও অন্যান্য কর এর সাথে রাজস্ব সংক্রান্ত নান সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। অশোকের শিলালিপিতে তখনকার সময়ে ভূমির উপর রাজার মালিকানা বাদের ব্যক্তিগত মালিকানার কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়। জমির উপর রাজস্ব আদায় ছাড়াও বাণিজ্য, শুল্ক, জন্ম ও মৃত্যু কর আদায় করা হত। তাছাড়া রাজার ভূসম্পত্তি, বন ও খনি থেকে আদায়কৃত কর দিয়ে রাজ পরিবার ও কর্মচারীদের পরিচালনাসহ রাজ্যে উন্নতিমূলক কাজ করা হত।

বিচার ব্যবস্থা: রাজা ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারপতি। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। অর্থশাস্ত্রে দু-প্রকার বিচারালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- ধর্মস্থানীয় ও কন্টকশোধন। এগুলো অমাত্য ও শাস্ত্রজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত হত। এগুলো বাদেও জনপদ ও নগরে বিশেষ নিম্ন বিচারালয় ছিল। এসব নিম্ন বিচারালয়গুলির মধ্যে ছিল- স্থানীয়, দ্রোনামুখ প্রভৃতি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় বিচার সবার জন্য সমান ছিল। তাঁর শাসনামলে ব্রাক্ষ্মণরাও গুরুদন্ড থেকে অব্যহতি পেতেন না। সেসময় লিখিত আইন না থাকায় ধর্ম, ব্যবহার, চরিত্র, রাজানুশাসন ইত্যাদি আইন বলে বিবেচিত হত।

গুপ্তচর বিভাগ: বিশাল সাম্রাজ্যে সংহতি রক্ষার জন্য এবং সেনাবাহিনী, রাজকর্মচারী তথা সকল জনসাধারণের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবহিত থাকার জন্য রাজা বহুসংখ্যক গুপ্তচর নিযুক্ত করতেন। অর্থশাস্ত্রে দু-প্রকার গুপ্তচরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা রাজাকে সকল প্রকার গোপন সংবাদ পরিবেশন করত।

২) প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণাঞ্চল এই চারটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। রাজা নিজে পাটলিপুত্র থেকে প্রদেশগুলি শাসন করলেও তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা কুমার নামে পরিচিত ছিলেন।

প্রদেশগুলি কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। জনপদগুলির শাসনভার শাসক কর্মাচারীদের ওপর ন্যস্ত থাকত। প্রদেশসমূহে ‘অন্তপাল’ ও ‘দূর্গপাল’ নামক কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রামের শাসন ব্যবস্থা ‘গ্রামিক’ নামক কর্মচারীর উপর ন্যস্ত থাকত। এরা যথাক্রমে সীমান্তরক্ষা ও দূর্গরক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকতেন।

উপসংহার

দেশরক্ষক, সংগঠক ও প্রজাহিতৈষী রাজা হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছেন। তাঁর শাসনপ্রণালী ছিল শক্তিশালী ও জনকল্যাণমূলক। শাসনযন্ত্রেও সাহয্যে তিনি অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও বৈদেশিক আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

Related Posts