‘রসবাহিনী’ পালি গ্রন্থটি রস ও বাহিনী এই দুটি শব্দ দ্বারা গঠিত একটি যৌগিক শব্দ। রস শব্দের অর্থ স্বাদ, আস্বাদ, রসেন্দ্রিয়গ্রাহ্য মাধুর্যাদি গুণ, কাব্যশাস্ত্রে সারভূত মনঃপ্রীতি, মজা, আনন্দ, অনুরাগ, অভিপ্রায়, সম্ভোগ, আস্বাদ্য যেকোনো রস বা বিষয়, ভোগ্য বস্তু ইত্যাদি বোঝায়। বাহিনী শব্দে বহনকর্ত্রী, বহনকারিনী, যা বহন করে ইত্যাদি বোঝায়। সুতরাং রসবাহিনী শব্দের অর্থ হয়, আস্বাদ বহনকারিনী, আনন্দ বহনকারিনী, কাব্যশাস্ত্রে সারভূত মনঃপ্রীতি বহনকারিনী, অনুরাগ বা অভিপ্রায় বহনকারিনী। এর শাব্দিক অর্থ রসের প্রবাহ (The flow of tastes)। লেখক যে অর্থে ‘রস’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে সদম্মের নিগূঢ় তত্ত্বরস, যে রস অমুততুল্য স্বাদযুক্ত, যে রস সকল প্রকার রসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (সব্বং রসং ধম্মরসো জিনাতি, ধম্মপদ)। লেখক স্বয়ং রসবাহিনী কে ধর্মামৃতরস বলে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন: রাজা মিলিন্দ কে ছিলেন? তার জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দাও।
বৃক্ষদেবতার উপাখ্যান:
এক সময় লঙ্কাদ্বীপে (শ্রীলংকা) বার বছর পর্যন্ত ব্রাক্ষনানিয়া নামে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। এ সময় বহু লোক দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। যারা জীবিত ছিল তারা অল্প খাদ্য পানীয় ভোজনের কারণে অস্থিচর্মচার রক্তহীন মাংস-অস্থি শৃঙ্খলিত পশাচের মত অতি দুঃখে-কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করত। তখন রাবকবৃষ্টি গ্রামে পাঁচশত কুল-গৃহে পূর্ব হতে দানপতি দায়ক দুর্ভিক্ষের ভয়ে দানকার্য বন্ধ করেছিল। তখন এক গৃহের মানুষেরা গোপনে এক পাত্র চাল ছিন্ন বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে গরমজলে নিক্ষেপ করে/দিয়ে চালের জলপান করে পুনরায় চাল তাপে শুষ্ক করে পাত্রে রেখে চোরের ভয়ে মাটি খনন করে রেখে দিল। এভাবে তারা জীবিকা নির্বাহ করেছিল। এক ভিক্ষু সুচারুরুপে চীবর পরিধান করে সেই গ্রামে ভিক্ষার জন্য প্রবেশ করে পাত্র ধৌত করে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তারা সেভাবে স্থবিরকে প্রত্যাগমন করতে দেখে সকলে একমত হল যে, “ আমরা পূর্বজন্মে দান দেইনি বলে এই দুর্ভিক্ষজনিত দুঃখ ভোগ করছি। যদিও আমরা এই চালের কারণে অধিক দুঃখ ভোগ করি নাই।” তারা এরুপ চিন্তা করে ভিক্ষুর হাত থেকে পাত্রটি গ্রহণ করে সেই চালগুলো রান্না করে স্থবিরকে দান দিলেন। তাদের শ্রদ্ধা শক্তি দ্বারা ভাতের পাত্রটি সঙ্গে সঙ্গে ভাত দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেল। তারা এরুপ অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। পাত্র থেকে ভাত নেয়ার পর আবার পাত্রটি ভাতে পূর্ণ হত। এভাবে তারা বহুলোককে খাইয়ে সবশেষে নিজেরা আহার করল। স্থবির অন্ন গ্রহণ করে সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে মহাইন্দ্র বরুণ বৃক্ষমূলে উপনীত হলেন। এবং সেখানে উপবেশন করে আহার করতে লাগলেন। সেই বৃক্ষে বসবাসরত ক্ষুধায় ক্লান্ত এক দেবপুত্র স্বীর বেশ ত্যাগ করে এক বৃদ্ধের বেশে আহাররত স্থবিরের সামনে দাঁড়ালেন। স্থবির অন্যমনে আহার করছিলেন। তিনি শেষ গ্রাস মুখে দেয়ার আগে দেবপুত্র কাশি দিয়ে স্বীয় উপস্থিতি জ্ঞাপন করলেন। স্থবির তাকে দেখে তীব্র অনুতাপ বোধ করলেন এবং সেই ভাতের শেষ গ্রাসটি বৃদ্ধের হাতে তুলে দিলেন। ভাতের গ্রাস হাতে নিয়ে দেবতা চিন্তা করতে লাগলেন, ইতিপূর্বে আমি কোনো শ্রামণ-ব্রাক্ষ্মণ, দরিদ্র কিংবা কোনো কাক-কুকুরকে পর্যন্ত আহার দান করিনি। তাই দেবতা হলেও ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করছি। এই ভাতের পিন্ড দান করলে নিশ্চই আমার দীর্ঘ সময়ের হিত ও সুখ উৎপন্ন হবে। এরুপ চিন্তা করে অন্ন পিন্ডের প্রতি আসক্তি পরিহার করে স্থবিরের সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘প্রভু, এই দাসের ইহজীবনে পাওয়ার দরকার নেই, পরলোকের সংগ্রহের প্রয়োজন।’ এইরুপ বলে তিনি ভাতের পিন্ডটি স্থবিরের পাত্রে দিলেন। অন্ন পিন্ড পাত্রে পতিত হওয়া মাত্র দিব্যময় খাদ্যেপূর্ণ আটটি পাত্র উৎপন্ন হল। স্থবির আহারকৃত্য শেষ করে নিজ স্থানে প্রস্থান করলেন। দেবপুত্র সেই দিব্য পানীয় দেখে তুষ্ট হয়ে ঘোষণা করলেন-
১। আজকের দিনটি আমার জন্য সুপ্রভাত ও সুখলব্ধ হয়েছে। আজ যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তিনি আমাকে সুগতরস দান করেছেন, শান্তি দান করেছেন।
২। যে ভিক্ষু সাক্ষাৎ আমি প্রাপ্ত হয়েছি তিনি সুন্দর আচরণ সম্পন্ন, আহুনেয্য, পাহুনেয্য (আহ্বান যোগ্য ও আতিথ্য দেওয়ার যোগ্য)। তাঁর কারণেই আজ আমার মঙ্গল সাধিত হয়েছে।
৩। যেখানে দিলে, যেখানে ত্যাগ করলে, যেক্ষেত্রে রোপণ করলে কালাকালহীন ভাবে ফল ফলে, আজ আমা কর্তৃক সেই মুণি দৃষ্ট হয়েছে।
৪। পূর্বজন্মে শ্রমণ-ব্রাক্ষ্মণ-যাচককে দান না করার কারণে আমি দেবতারুপে জন্ম গ্রহণ করেও খাদ্য-ভোজ্য লাভ করিনি।
৫। তিনি আমার প্রতি অনুগৃহীত হয়ে তাঁর শেষাংশ অল্পমাত্র যা আমাকে দিয়েছিলেন তাই আমি দান করেছি।
৬। আজ তাঁকেই দান করেছি যিনি দানের যোগ্য এবং অনুত্তর। আজই তার ফল প্রাপ্ত হয়েছি। অহো! কী মহৎ ক্ষেত্র।
৭। সুগত (বুদ্ধ) ধর্ম কালাকালহীন বলে যে কথিত, তার প্রত্যক্ষ ফল প্রাপ্ত হয়ে তার যথার্থতা আমার জ্ঞাত হয়েছে।
৮। আমি সব্যঞ্জন, সপোকরণ, উত্তম এবং অক্ষয় আটপাত্র অন্ন লাভ করেছি। অহো! দানের ফল কি মহৎ!
এরুপ বলে দেবপুত্র তথায় সমবেত সকলকে দান দিয়ে এরুপ বললেন,
৯। যিনি শীলবান ও পূত পবিত্র হয়ে শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র দান-রুপ বীজ বপন করেন, তজ্জনিত পুণ্য প্রভাবে তিনি স্বর্গারোহন করে বিপুল ভোগ সম্পত্তির অধিকারী হন।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে পরবর্তী সময়ে রচিত কিংবা সংকলিত পালি সাহিত্য ভান্ডারে রসবাহিনী একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংযোজন জাতক, পেতবত্থু, বিমানবত্থু, থেরগাথা, থেরী গাথা, ধম্মপদট্ঠকথা প্রভৃতি পালি গ্রন্থের গল্প-উপাখ্যানের মত রসবাহিনীর ঘটনাসমূহ পদ্য-গদ্যে বর্ণিত হলেও এটা পিটক পরবর্তীকালে সংকলিত একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির গল্প সংকলন। লেখক চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী বর্ণিত বিষয় প্রথমে গদ্যে ও পরে পদ্যে উপস্থাপন করেছেন বটে, কিন্তু বর্ণিত বিষয়বস্তুর ভাবপরিবেশ ভিন্নতর। এর কোনো কাহিনীর প্রধান চরিত্রের বর্তমান জীবনের সঙ্গে অতীত জীবনের যোগসূত্র দেখানো হয়েছে আবার কোনোটি শুধুমাত্র বর্তমান জীবন কাহিনীকে গল্পাকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।