ভূমিকা:
তথাগত ভগবান বুদ্ধের মূল তত্ত্বগুলোর উপদেশের সমষ্টি হল সুত্ত পিটক। সংযুক্ত নিকায় বৌদ্ধ পবিত্রগ্রন্থ ত্রিপিটকের অন্তর্গত সুত্তপিটকের তৃতীয় নিকায় বা অংশ। সংযুক্ত নিকায়ের ২৮৮৯ টি সূত্রের মধ্যে দেবতা সংযুক্তের জটা সূত্রটি অন্যতম। তদানীন্তন সময়ে তথাগত বুদ্ধের সাথে বহু পন্ডিত, দার্শনিক, ব্রাক্ষ্মণ, দেবতা ও মারের সাথে কথোপকথন হয়েছে। প্রশ্নোত্তর বৌদ্ধতত্ত্ব ও দর্শনের সেই বিষয়সমূহ সংযুক্ত নিকায়ে আলোচিত হয়েছে। জনৈক দেবতা তথাগত বুদ্ধকে জটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সূত্রটির সৃষ্টি হয়েছে। এই তৃষ্ণা ক্ষয় বা নিবারণ ব্যতিত কারো পক্ষে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। মানুষের অন্তর থেকে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার দ্বারা জটা দূর করা সম্ভব। জটাহীন মানুষ নির্বাণলাভী হন। নির্বাণ হল দুঃখ মুক্তির শেষ সোপান। তাই সব মানুষের উচিত নির্বাণ লাভের জন্য সাধনা করা। একারণে শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো ‘জট’ বা পেচানো ঝোপ-ঝাড়। কিন্তু বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাকে গভীর অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে ‘জটা’ বলতে লোভ, দ্বেষ ও মোহাদি তৃষ্ণাজালকে বোঝায়। সুতা, বাঁশ বা বেতে জট বাধলে যেমন তা সহজে মুক্ত করা যায় না, তেমনি তৃষ্ণা জালে আবদ্ধ মানুষ সহজে বন্ধনমুক্ত হতে পারে না।
আচার্য বৃদ্ধঘোষ তৃষ্ণাজালকে জটা জাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেননা তৃষ্ণা জালে আসক্ত মানব লোভ, দ্বেষ, মোহ জর্জরিত হয়ে দুঃখ সাগরে নিমজ্জিত হয়। এজন্য দুঃখকে নিরোধ করতে হলে তৃষ্ণা বা জটা জালকে ধ্বংস করতে হবে। উদাহারণস্বরুপ বলা যায- বাঁশ ঝাড়ে বাঁশের শাখা-প্রশাখা যেমন পরস্পর পরস্পরের সাথে আবদ্ধভাবে জট পাকিয়ে যায় এবং তা মুক্ত করতে উভয়কে কেটে ফেলতে হয়। তেমনিভাবে মানুষও অন্তরে বাইরে তৃষ্ণার জাল জড়িয়ে পড়ে আছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে তৃষ্ণাকে ধ্বংস করতে হবে।
আরও পড়তে পারেন: বোধিচিত্ত বলতে কি বুঝ? বোধিচিত্তের পরিগ্রহে আচার্য্য শান্তিদেবের অনুভূতি বিশ্লেষণ কর।
ব্রক্ষ্মজাল সূত্রে জটার অর্থ:
সংসারে মানুষ বিবিধ দৃষ্টি জালে আবদ্ধ। এই জাল থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চায়। অথচ পরক্ষণে আবার জড়িয়ে পড়ে। তারই আলোকে ভগবান বুদ্ধ বলেছেন – হে মানবগণ, তোমরা মিথ্যা দৃষ্টি জালে জড়িয়ে পরো না। আমার প্রতিষ্ঠিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বাণের পথ প্রশস্ত কর। তারই ফলে আসবে জটামুক্তির পথ। তাই বুদ্ধ ব্রক্ষ্মজাল সূত্রে ৬২ প্রকার মিথ্যা দৃষ্টির বর্জনের মাধ্যমে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন করে এ জটা থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন।
ধর্মপদানুসারে জটা:
ধর্মপদের মূল বর্গে এই জটা সম্পর্কে আলোকপাত করা আছে এভাবে-
“নত্থি মোহং সমং জালং অথবা, “নত্থি রাগোসমো অগগি (অগগির গ-তে হসন্ত হবে একটা)
নত্থি অহা সমা নদী নত্থি দোসসমো গহো
নত্থি রাগোসমো অগগি নত্থি মোহসমং জালং
নত্থি দোস্সো সমো কলি।” নত্থি তণহাসমা নদী” (ণ তে একটা হসন্ত হবে)
অর্থাৎ “মোহ সমান জাল নেই। তৃষ্ণার সমান নদী নেই। আসক্তির সমান অগ্নি নেই। দ্বেষের ন্যায় পাপ নেই।” পঞ্চস্কন্ধ স্বরুপ দুঃখ নেই। শান্তির ন্যায় সুখ নেই। এটাই বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা। পঞ্চস্কন্ধ থেকে মুক্ত হওয়াই জটা থেকে মুক্তি লাভ করা।