বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সমস্যা সমূহ
অতীতকাল হতে বাংলাদেশের কুটির শিল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নানাবিধ সমস্যার ভারে এ শিল্পের অস্তিত্ব ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। কুটির শিল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় সোয়া লক্ষ নতুন লোকের কর্মসংস্থান হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণে পল্লির সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ তথা ভূমিহীন ও মহিলাদের এ শিল্পের উপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। এদেশে কুটির শিল্পের গুরুত্ব এত বেশি থাকা সত্ত্বেও কুটির শিল্পের সমস্যার অন্ত নেই। নিম্নে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সমস্যাবলি বর্ণনা করা হলো:
১. মূলধনের স্বল্পতা: বাংলাদেশের কুটির শিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো মূলধনের স্বল্পতা। ফলে কুটির শিল্পেরউন্নয়ন ব্যাহত হয়।
২. ঋণের অভাব: কুটির শিল্পের জন্য দেশীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হলেও ঋণের অভাবে তা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
৩. প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি: বর্তমান যুগে কুটির শিল্পে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সমস্যা হলো এক্ষেত্রে প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
৪. কাঁচামালের অভাব: এদেশে উৎপন্ন কাঁচামালের অধিকাংশই বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। ফলে কুটির শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৫. শ্রমিকদের অশিক্ষা: বাংলাদেশের কুটির শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা অশিক্ষিত। ফলে আধুনিক উৎপাদনের কলাকৌশল সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ। তাই রুচি ও পছন্দমাফিক দ্রব্য উৎপাদনে তারা পারদর্শী নয়।
৬. কারিগরি জ্ঞানের অভাব: এদেশের কুটির শিল্পের শ্রমিকরা নিরক্ষর, তাদের কারিগরি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে আধুনিক রুচি ও ফ্যাশন অনুযায়ী দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে না।
৭. স্বল্প মজুরি: কুটির শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মজুরি কম হয়। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নীচু হয়। এ কারণে অনেক সময় শ্রমিকেরা অন্য পেশায় চলে যায়।
৮. পরিবহন ও যোগাযোগের সমস্যা: পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাতকরণে অনেক সমস্যা হয়।
৯. সীমাবদ্ধ বাজার: দিন দিন কুটির শিল্পের বাজার সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। বৃহৎ শিল্পের অসম প্রতিযোগিতার ফলে কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
১০. অপর্যাপ্ত শক্তি সম্পদ: পর্যাপ্ত শক্তি সম্পদের অভাবের কারণে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের আধুনিকীকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
১১. নিম্নমানের পণ্য-দ্রব্য: কুটির শিল্পের শ্রমিকরা প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতিতে দ্রব্য উৎপাদন করে বলে উৎপাদিত পণ্যের মান হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এর চাহিদাও হ্রাস পাচ্ছে এবং মূল্যও কমে যাচ্ছে।
১২. মধ্যবর্তী দালালদের প্রভাব: এ শিল্পের অশিক্ষিত মালিকরা তাদের উৎপাদিত দ্রব্য সরাসরি ক্রেতাদের নিকট বিক্রয় না করে মধ্যবর্তী দালালদের নিকট কম দামে দ্রব্য বিক্রয় করতে বাধ্য হয় বলে পণ্যের ন্যায্যমূল্য হতে তারা বঞ্চিত হয়।
১৩. সরকারি সহযোগিতার অভাব: সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এদেশে কুটির শিল্পের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।
১৪. বিদেশি পণ্যের অবাধ আমদানি: বাংলাদেশে বিদেশি পণ্যের অবাধ আমদানির কারণে আমাদের কুটির শিল্পপণ্যের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে।
১৫. সমবায়ী মনোভাবের অভাব: কুটির শিল্পীদের সমবায়ী মনোভাবের অভাবের কারণেও এদেশে এই শিল্পের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
১৬. আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব: বাংলাদেশে কুটির শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এর ফলে উৎপাদিত দ্রব্যাদিও নিম্নমানের হয়।
১৭. ভোক্তাদের প্রতিকূল মনোভাব: এদেশের কুটির শিল্পের ভোক্তাদের চাহিদা, রুচি ও পছন্দের পরিবর্তন এবং বিদেশি পণ্যের প্রতি আকৃষ্টতার কারণে দেশীয় শিল্প পণ্যের চাহিদা হ্রাস পায়।
১৮. প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের উৎসের অভাব: গ্রামীণ কুটির শিল্পের মালিক-এর সহজশর্তে প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার কোনো সুবিধা নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের গুরুত্ব আলোচনা কর |
বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সমস্যা সমাধানের উপায়
বাংলাদেশের কুটির শিল্পের পণ্যসামগ্রী এককালে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের বিকল্প পণ্য আবিষ্কৃত হওয়ায় অতীতের সেই ঐতিহ্য আর নেই। এ প্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থার উন্নতি করে কুটির শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করতে হবে:
১. আধুনিকীকরণ: বাংলাদেশের কুটির শিল্পে প্রাচীন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে।
২. ক্রেতাদের রুচি ও পছন্দের মূল্যায়ন: বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভোক্তা বা ক্রেতাদের রুচি ও পছন্দের অবস্থা কী রকম, সেদিকে খেয়াল রেখে পণ্য তৈরি বা উৎপাদন করতে হবে।
৩. পর্যাপ্ত মূলধন সরবরাহ: কুটির শিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধনের অভাব পূরণের জন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে পর্যাপ্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. বিদ্যুৎ শক্তির প্রসার: দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ শক্তিকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কুটির শিল্পের উৎপাদন খরচ অনেক হ্রাস পায়।
৫. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: কুটির শিল্পে নিয়োজিত কারিগরদের জন্য গ্রামাঞ্চলে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. দক্ষতা বৃদ্ধি: মৃৎ শিল্প, শঙ্খ শিল্প, রেশম শিল্প ইত্যাদি শিল্প কারখানার শ্রমিকদেরকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এতে করে পণ্যের মান উন্নত হবে এবং ভোক্তাদেরকে পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে।
১৭. কাঁচামালের পর্যাপ্ত যোগান: কুটির শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করতে হবে।
৮. টেকসই ও সস্তায় পণ্য উৎপাদন: বৃহদায়তন শিল্প পণ্য যেন টেকসই এবং সস্তা হয়, সেদিকেও কুটির শিল্পকে খেয়াল রাখতে হবে। নতুবা কুটির শিল্পের বাজার আরও সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।
৯. ঋণের যোগান: কুটির শিল্প যাতে সহজে ঋণ পেতে পারে, সেজন্য সমবায় ঋণদান সমিতিসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিধি পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়াতে হবে।
১০. মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যবহার: বৃহৎ শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার জন্য কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কিছু মূল্যবান যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য সরকারি সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন।
১১. উৎপন্ন দ্রব্যের মান নির্ধারণ: কুটির শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্যসমূহের মান নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন: সমবায় বাজার সমিতি গঠন, বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদির বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
১৩. সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ: সংরক্ষণ নীতি অনুসরণের মাধ্যমে কুটির শিল্পকে বিদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
১৪. ব্যাপক প্রচার: এ শিল্পজাত পণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সিনেমা হল প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার কার্য চালাতে হবে।
১৫. পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন: কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য দেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হলে সহজেই কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের বাজারজাতকরণ সম্ভব হয়।
১৬. বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা: কুটির শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও আনুষাঙ্গিক সুবিধার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত পুঁজি সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে কুটির শিল্প বিষয়ক বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
১৭. দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ: দেশের জনগণকে স্বদেশপ্রেমে জাগ্রত করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
১৮. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা: কুটির শিল্পসমূহকে আরও অধিকতর উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন।
উপসংহারে বলা যায়, উপরিউক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করলে কুটির শিল্পের বর্তমান সমস্যাবলির সমাধান সম্ভব হবে। এর ফলে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।